এক দশক ধরে নিজের সর্বস্ব দিয়ে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করান স্ত্রী। নিজের কিডনি দিয়ে জীবন বাঁচানোর পর সেই স্বামীর হাতেই নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অকৃতজ্ঞতার এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে সাভারের কলমা এলাকায়।
ভালোবাসা ও ত্যাগের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন ৩৫ বছর বয়সী উম্মে সাহেদীনা টুনি। মরণাপন্ন স্বামীকে নিজের একটি কিডনি দিয়ে নতুন জীবন দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই জীবন ফিরে পেয়েই ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে টুনিকে প্রতারণা, নির্যাতন আর বঞ্চনা উপহার দিয়েছেন তার স্বামী মোহাম্মদ তারেক। সুস্থ হয়েই তিনি জড়িয়ে পড়েন পরকীয়া ও অনলাইন জুয়ায়। এক পর্যায়ে জীবন বাঁচানো স্ত্রীকেই মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে এখন তিনি প্রেমিকার সঙ্গে বসবাস করছেন। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী টুনি নারী নির্যাতনের মামলা করলে তারেক গ্রেপ্তার হলেও বর্তমানে জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
২০০৬ সালে মালয়েশিয়া প্রবাসী তারেকের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় টুনির। বিয়ের দুই বছরের মাথায় তাদের কোলজুড়ে আসে পুত্রসন্তান আজমাইন দিব্য। সুখের সংসারে হঠাৎই নেমে আসে অন্ধকার। ২০০৮ সালে তারেকের দুটি কিডনিই অকেজো হওয়ার দুঃসংবাদ পান টুনি।
কিন্তু স্বামীর এমন অবস্থায় ভেঙে না পড়ে তার হাত শক্ত করে ধরেন টুনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য স্বামীকে নিয়ে পাড়ি জমান ভারতের তামিলনাড়ুর সিএমসি হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানান, তারেকের কিডনি মাত্র ২৪ শতাংশ কার্যকর এবং ওষুধ দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছর চালানো সম্ভব, এরপর প্রতিস্থাপন করতেই হবে।
স্বামীর চিকিৎসার বিপুল খরচ জোগাতে টুনি ঢাকায় নিজের বাড়িতেই গড়ে তোলেন বিউটি পার্লার ও বুটিকসের ব্যবসা। নিজের জমানো টাকা, বিয়ের স্বর্ণালংকার এমনকি মায়ের পেনশনের টাকাও স্বামীর চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করেন। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলে এই সংগ্রাম।
২০১৯ সালের শুরুতে চিকিৎসকরা কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা বললে পরিবারের অন্য সদস্যরা অপারগতা প্রকাশ করে। তখন টুনি নিজেই এগিয়ে আসেন। ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে নিজের একটি কিডনি দিয়ে স্বামীর জীবন বাঁচান তিনি।
টুনি ভেবেছিলেন, তার কষ্টের দিন হয়তো এবার শেষ হলো। কিন্তু কিডনি পেয়ে সুস্থ হতেই তারেকের আসল রূপ প্রকাশ পেতে থাকে। হাসপাতালের কেবিনেই টাকা নিয়ে তুচ্ছ কারণে টুনির ওপর চিৎকার শুরু করেন তিনি।
দেশে ফেরার পর টুনির জীবনে নরক নেমে আসে। তারেক কোনো কাজ তো শুরু করেনইনি, উল্টো টুনির উপার্জনের সব টাকা তার হাতে তুলে দিতে এবং বাবার বাড়ি থেকে আরও টাকা এনে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি তাহমিনা নামের এক ডিভোর্সি নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় এবং অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে টুনির ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। টুনি বলেন, "যেই মানুষটার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছি, সে-ই আমার পেটে অপারেশনের জায়গায় লাথি মারলো! পুরো বাড়ি তার নামে লিখে দিয়ে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে।"
নির্যাতন সইতে না পেরে টুনি সাভার থানায় অভিযোগ করেন। কিন্তু ধূর্ত তারেক তাকে বুঝিয়ে অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য করেন। এরপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলে টুনি বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং ২২ এপ্রিল ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা করেন।
সেই মামলায় ২৪ এপ্রিল তারেক গ্রেপ্তার হন এবং প্রায় এক মাস কারাগারে থাকার পর ৪ জুন জামিনে মুক্তি পান। জামিনে বেরিয়েই তিনি পরকীয়া প্রেমিকার বাড়িতে উঠেছেন এবং সেখান থেকে টুনিকে ডিভোর্স ও বাড়ি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
ভুক্তভোগী টুনির আর্তি: "আমার স্বামীকে ফেরেশতার মতো মনে করতাম। তার জন্য পরিবারের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেছি। অথচ সেই মানুষটা আজ আমার সব কেড়ে নিল। আমি চাই না, আমার মতো পরিণতি আর কোনো মেয়ের হোক।"
পরিবার ও প্রতিবেশী: টুনির মা বলেন, "ফ্ল্যাট বিক্রি করে ওদের থাকার জন্য বাড়ি তুলে দিয়েছিলাম। মেয়ের চিকিৎসায় পেনশনের সব টাকা দিয়েছি। আজ সেই বাড়ি লিখে দেওয়ার জন্য আমার মেয়েকে নির্যাতন করছে।" প্রতিবেশীরাও টুনির ত্যাগ এবং তারেকের অকৃতজ্ঞতার কথা স্বীকার করেছেন।
আইনজীবীদের পর্যবেক্ষণ:
টুনির আইনজীবী নেহার ফারুক জানিয়েছেন, তিনি চার্জশিট হাতে পেলেই তারেকের জামিন বাতিলের আবেদন করবেন এবং আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে লড়বেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান এই ঘটনাকে মর্মান্তিক উল্লেখ করে বলেন, "এ ধরনের প্রতারকদের কারণে সত্যিকারের ভালোবাসার ওপরও মানুষের বিশ্বাস উঠে যায়।" তিনি টুনিকে নারী নির্যাতন মামলার পাশাপাশি মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ও ভরণপোষণের মামলা করার পরামর্শ দেন। এছাড়া নিজের সুরক্ষার জন্য আদালতের কাছে সুরক্ষা আদেশ চাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে তারেক পলাতক রয়েছেন এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার পরিবারও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। ভালোবাসা ও ত্যাগের এমন প্রতিদান দেখে সমাজের সব স্তরের মানুষ হতবাক এবং তারা এই অমানবিক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন। উৎস: ইত্তেফাক।