মানবজমিন প্রতিবেদন: ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল ৫টা ১০ মিনিট। ২৩, গুলিস্তান আবরার ফাহাদ এভিনিউয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। আশপাশে দোকানপাট থাকলেও তেমন একটা ভিড় নেই এখানে। এক সময়ের সুসজ্জিত ভবনটি এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে। জুলাইযোদ্ধাদের কার্যালয় লেখা একটি ব্যানার ঝুলতে দেখা গেলেও ভেতরে এর কোনো আলামত দেখা যায়নি। ভবনের সামনেও তেমন একটা লোকজনের দেখা পাওয়া যায়নি। ভবনের ভেতর ঢোকার আগ থেকে মলমূত্রের দুর্গন্ধ নাকে আসছিল। ভবনের আশপাশে অবস্থান করা লোকজন জানান, স্থানীয় হকার থেকে শুরু করে পথচারীরাও ভবনটিকে শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভবনের সামনে ঝাল মুড়ি বিক্রি করেন শরিয়তপুরের অধিবাসী সাব্বির হোসেন।
৫ই আগস্টের পর তিনি প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এখানে ভাসমান দোকান নিয়ে বসেন। তিনি বলেন, দিবারাত্রি এখানে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখি। তবে আমি আমার দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কে কী করছে তেমন খেয়াল করতে পারি না। সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলার সময় ভবনের সম্মুখভাগের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত গলা টানটান করে দেখছিলেন মুন্সীগঞ্জ থেকে আগত সংবাদকর্মী অতিকুর রহমান টিপু ও রুবেল। ভাই কী দেখছিলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে আতিকুর রহমান বলেন, এক সময় এই ভবন ছিল দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। আজ সেই জায়গার এই অবস্থা! তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের পর এই দিকে আর আসা হয়নি। আজ দেখতে আসলাম। যা দেখলাম তা কল্পনাতীত।
এ সময় পেছন থেকে আরেক জন পথচারী উচ্চস্বরে বলেন, এই দৃশ্য মাহবুব-উল আলম হানিফকে দেখাতে পারলে শান্তি পেতাম। ভবনের ভেতর প্রবেশ করে দেখা যায়, নিচতলা পুরো অন্ধকার। দুই পাশের দেয়াল পুড়ে কালো হয়ে আছে। দু’টি রুমে নোংরা পানি জমে আছে। নিচতলা জুড়ে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখা যায়, বাথরুম থেকে শুরু করে কোনো কক্ষে কিছু নেই। এসব কক্ষ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের দরজাও খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দরজা খুলতে গিয়ে ভবনের দেয়াল ভাঙতে হয়েছিল। সেখানে ইটের খোয়া ও কাঁচের টুকরা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বহু জায়গায় সিঁড়িও ভাঙা রয়েছে। এমনকি ভবনের ছাদেও ভাঙচুর চালানোর ফলে কোন কক্ষটি কোন কাজে ব্যবহার হতো, তা বোঝার উপায় নেই।
ভবনটির তিনতলা পর্যন্ত মলমূত্রের গন্ধ পাওয়া গেলেও চারতলা থেকে প্রতিটি তলায়ই ইটপাথরের ধ্বংসাবশেষ স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছয় ও সাত তলায় দেখা যায়, তলা দু’টির শেষ দিকের বাঁ পাশের রুমের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করে কিছু অংশ থাকার ও বসে আড্ডা দেয়ার মতো করা হয়েছে। তবে সেখানে কোনো লোকজনের দেখা পাওয়া যায়নি। সেখানে একাধিক ছেঁড়া স্যান্ডেল, কয়েকটি সিগারেটের প্যাকেট ও কিছু জামাকাপড় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
লোকজনের দেখা না পাওয়া গেলেও ভবনের বাইরে অবস্থান করা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনের ওই তলা দু’টিতে কয়েকজন মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তবে প্রায় সময় গণমাধ্যমের লোকজন আসা-যাওয়া করায় তারা স্থান ত্যাগ করে। তারা ছিন্নমূল মানুষ বলে জানা গেছে। এ ছাড়া রাতে আরও অনেক লোক ভবনে প্রবেশ করে বলে জানা গেছে। রাতে মাদক এবং জুয়ার আড্ডার পাশাপাশি অসামাজিক কার্যকলাপও চলে।
ভবনের আশপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর আগস্ট মাস জুড়ে বিভিন্ন সময় ভবনটিতে লুটপাট চালানো হয়।
গুলিস্তানে ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ১০ তলাবিশিষ্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি ২০১৮ সালের ২৩শে জুন উদ্বোধন করেছিলেন দলের সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।