সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর, বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ও জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে।
থানচি উপজেলার মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বঙ্কুপাড়া এলাকায় দেখা যায় কয়েকটি পাহাড় মিলিয়ে কেবল কয়েক ঘর বসতি। নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে কোনোমতে চলাফেরা করেন তারা। বাংলা ভাষার বুলি তাদের মুখে ফোটেনি। পাহাড়ে জুমচাষ করে নিজেদের আহার জোগান। শিক্ষা কিংবা চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন মনে করে না তারা। বেশিরভাগ মানুষের পাহাড়েই জন্ম, আবার পাহাড়েই মৃত্যু।
পাহাড়ের বাসিন্দা ডায়মন্ড ম্রোং বলেন. অসুখ হলে পরিবারের সদস্যদের হাসপাতালে নেওয়া যেতো না। পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। এখন সড়ক হওয়ার কারণে সবকিছু সহজ হবে। আর্মির করে দেওয়া স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনাও করছে।
পাহাড়ের এই বাসিন্দারা বেশিরভাগই জানতেন না দেশের শিক্ষা ও চিকিৎসা সম্পর্কে। সেনাবাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের সচেতন করছে। নিজেদের অর্থায়নে এখন পর্যন্ত স্কুল করেছে ৩টি। বান্দরবানের থানচি উপজেলার শালোকিয়াপাড়া, রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মিলনছড়ি এবং একই জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার গবাইছড়ি এলাকায় স্থাপিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে প্রায় ২৫০ শিক্ষার্থী। নতুন করে নির্মিত সড়ক ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা সহজেই যাতায়াত করতে পারছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
থানচি থেকে রেমংপাড়া সীমান্ত সড়কের পাশে অবস্থিত শালোকিয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাগরিকা ত্রিপুরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একসময় আমাদের পড়ালেখা করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। নানা প্রতিকূলতায় বেশিদূর যেতে পারিনি। আজ থেকে ৫ বছর আগেও বান্দরবান শহরে যেতে আমাদের অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হতো। মনে হতো যেন বিদেশে যাচ্ছি। প্রথমে আমরা থানচি যাওয়ার জন্য রওনা দিতাম। পথিমধ্যে আমাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে রাতে থাকতে হতো। পরদিন থানচি পৌঁছাতাম। এরপর গাড়িযোগে সেখান থেকে বান্দরবান যেতাম। ঠিক একইভাবে ফিরতাম। সবমিলিয়ে যাতায়াতে লাগত ৪ দিন। এখন আমাদের তেমন কষ্ট নেই, আমরা এখন গাড়িতে করে দিনে দিনে যাতায়াত করতে পারি।
সাগরিকাদের এমন কষ্ট দেখেছেন সীমান্ত সড়ক বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। মেজর পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা জুবায়ের আল হাসান কর্মরত রয়েছেন ১৭ ইসিবিতে। তিনি বলেন, দুবাই কিংবা বাইরের কোনো দেশে যেতে যেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া লাগে, তাদের আগে নিজ জেলা শহরে যেতে এমন প্রস্তুতি নিতে হতো। এখন সড়ক নির্মিত হওয়ায় তাদের যাতায়াত সহজ হয়েছে। অনেকটা দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তারা যুক্ত হয়েছেন।
থানচি উপজেলার ৩১ কিলো বিজিবি ক্যাম্প এলাকার প্রদীপ পাড়ার বাসিন্দা প্রদীপ ত্রিপুরা। মিয়ানমার সীমান্তের পার্শ্ববর্তী এলাকার এই বাসিন্দা দুর্গম পাহাড় থেকে গিয়ে বান্দরবান সরকারি কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে পড়াশোনা করতেন। তবে তিনি কোর্স শেষ করতে পারেননি। এ কারণে আক্ষেপ রয়েছে তার। প্রদীপ ত্রিপুরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে পায়ে হেঁটে থানচি যাওয়া-আসা করতাম। সরাসরি এখান থেকে যাতায়াত করে পড়াশোনা করতে পারিনি। পরিবার পরিজনকে ছেড়ে শহরে কোথাও থেকে পড়াশোনা করতে হতো। এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এ কারণে পরিবারের কেউ মারা গেলেও খবর পেতাম না। এসব প্রতিকূলতার কারণে এখানকার বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করতে পারেনি। আমি শুরু করেও শেষ করতে পারিনি। এখন সড়ক হয়ে যাওয়ায় এলাকার বাসিন্দারা শহরে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে।
রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মাঝিপাড়া মিলনপুর এলাকার বাসিন্দা লিটন চাকমা জানান, ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে সিজক হাইস্কুল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন তিনি। অল্প দূরত্বের এই স্কুলে বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করে পড়াশোনা করা যেত না আগে। ভাড়া বাসা কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে হতো। এ কারণে তিনিসহ বেশিরভাগই ছেড়ে দিয়েছেন পড়াশোনা। এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা আসা-যাওয়া করে পড়াশোনা করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সীমান্ত সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে পাহাড়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন আসবে। দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেসব অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছিল, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই এবং দ্রুত ওইসব অঞ্চলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের আওতাধীন ১৭ ইসিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে একটি বড় প্রতিবন্ধকতার নাম যোগাযোগ। আগে পাহাড়ি বাজারে যেতে পার্বত্য অঞ্চলের লোকজনের সারাদিন হাঁটতে হতো, এখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সড়কপথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ের বাসিন্দারা এখন সহজে শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ নানা সেবা পাচ্ছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যে কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানেই সমাজ ও রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়া। সেনাবাহিনীর দুর্গম পাহাড়ে করা এ সড়ক অনেকটা মহাযজ্ঞ বলা যায়। এতে পাহাড়িদের জীবনমান উন্নত হবে। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।