সুমন্ত আসলাম: মাকে ফেলে গেলো শালবনে, মাঝরাতে। বাবা মারা গেলেন, দেহ নিলো না তার সন্তান, পড়ে রইলো হাসপাতালেই, নিলো কেবল ‘মৃত্যুসনদ’, যেন পেনশনের টাকা পেতে কষ্ট না হয় তাদের। নয় বছরের মেয়েটা ক্ষুধার জ্বালায় বের হয়েছিলো রাস্তায়, কামুক পুরুষ তার সব কেড়ে নিলো, অথচ সে কেবল ভাত চেয়েছিল। পরাজিত পুরুষটা তার ‘অপৌরষ’ ঝাড়ল হাত-পা বেধে বউকে কুপিয়ে। আর মুখার্জি বাড়ির বউ না, তালুকদার বা চৌধুরী বাড়ির বউও না, সাধাসিধে এক পরিবারের বউ নেমেছিল সেদিন রাস্তায়, সম্বল তার দেহখানি। পক্ষাঘাতে স্বামী বিছানায় দুবছর, প্রতিদিন ওষুধ লাগে দেড়শ টাকার, চার আর তিন বছরের বাচ্চা দুটো একটু পরপরই চেচায়মা খিদা লাইগছে...।
বউটার ঠোঁট দুটো কাঁপছিলোলজ্জায়? না ক্ষুধায়? আজ যা লিখছি...কাল রাতে মা এসেছিলো আমার ঘরে। আমি অবাক হইনি একটুও। অথচ আট বছর আগে মা চলে গেছেন আমাকে ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে। বিছানায় বসল মা। স্বর্গমোড়ানো হাত রাখল কপালে। বললো, ‘আমি তো প্রায়ই আসি। অবাক হবি না কখনো, বাপ।’ আমি বলি, ‘মা, তুমি পরীমণিকে চেন?’ ‘কোন পরীমনি?’ ‘হেলেনা জাহাঙ্গীরকে?’ ‘তোর হেলেনা খালা?’ ‘ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহারকে?’ ‘এসব কাদের নাম বলছিস তুই?’ ‘কাল আর আজ মিলে যে সাতাশ লাখ গার্মেন্টসকর্মী ঢুকল ঢাকায়, তার সাড়ে ষোলো লাখই মেয়ে। তাদের মধ্যে লাবণীকে চেন তুমি? রুম্পাকে? শেফালীকে?’ ‘আমি তাদের চিনব কী করে বাবা!’ ‘নিজেকে দানব বানানো কিছু মহিলা, আর সম্ভ্রম ও মানুষ পরিচয় হারানো কিছু মহিলাতাদের নিয়েই আমাদের নিত্যবাস। এবার বলো তো তুমিতাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে কারা?
কারা কাউকে মাথায় ওঠায়, কাউকে পায়ে পেষে নিয়মিত? এই ভাগ্য নিয়ন্ত্রক-নীতি নির্ধারকদের তুমি চেন?’ ‘না-য়া-য়া।’ ‘অথচ তুমি মদন মোহন তর্কালংকারকে চেনো, রাম সুন্দর বসাককেও। বেলন দিয়ে কাঠের পিঁড়িতে রুটি বানাতে আর পড়াতে তুমি আমাদেরঅ আ ই ঈ। তারও কয়দিন পরগুরুজনকে ভক্তি কর, চোরকে সকলে ধিক্কার দেয়, দম্ভ করা অনুচিত, কদাচ অসৎ কল্পনা করিও না, গ্রগল্ভতা ভালো নয়, পশ্চাৎ ভাবিয়া কার্য করিবে, দৌরাত্ম্য ভালো নয়; আরো কতো কী পড়াতে, শেখাতে! মাঝে মাঝে মেঘ ডেকে উঠত গর্জনে, টিনের চালে ভূতের ভয় অথবা মাঝরাতে শেয়ালের ডাকতুমি দু হাতে জড়িয়ে ধরতে আমাকে, বুকে মিশিয়ে দিতে আমার মাথা, আয়তুলকুরছির ফুঁয়ে নির্ভয় করতেভয় নেই বাপ, আমি আছি না! মারে, তোমাকে যে আরও একবার দরকার, এই সময়ে; যে তার সমস্ত ভালোবাসায় ঠোঁট কাঁপিয়ে বলবেভয় নেই রে বাপ, আমি আছি, আমার ভালোবাসা আছে। আমি তোমার জন্য কাঁদছি মা, আমি তোমার মতো কারো অপেক্ষায় নির্ঘুম চেয়ে আছি গগনে। ফেসবুক থেকে