শিরোনাম
◈ নুর ইস্যুতে গণঅধিকার পরিষদের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ◈ কঠিন সমীকরণের সামনে বাংলাদেশ সুপার ফোরে যেতে ◈ গত অর্থবছরে ব্যয় সংকোচনে সরকারের ৫৬৮৯ কোটি টাকা সাশ্রয় ◈ মানুষের জন্ম হয়েছে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য: প্রধান উপদেষ্টা ◈ যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ কমাতে চায় সরকার ◈ ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ ◈ মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ঢাকা আসছে আজ ◈ চীনা দূতাবাস কর্মকর্তাদের দক্ষিণ এশিয়ায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ, ভারতকে সতর্ক থাকার আহ্বান তিব্বতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাংয়ের ◈ সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি, সেই ফারিয়াসহ তিনজন কারাগারে ◈ ক্যালিফোর্নিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে তামাকের মতো সতর্কবার্তা প্রদর্শনের বিল অনুমোদন

প্রকাশিত : ০৭ অক্টোবর, ২০২২, ০২:৪২ রাত
আপডেট : ০৭ অক্টোবর, ২০২২, ০২:৪২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বিএনপি-জোটের রাষ্ট্র মেরামত তত্ত্ব : কতোটা বিশ্বাসযোগ্য?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং গণতন্ত্র  মঞ্চের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে অভিন্ন সুরে দাবি করছেন যে, বর্তমান সরকার দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। ফলে এটিকে মেরামত করতে হবে; সে কারণেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় করে তারা দেশে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আগামী দিনের জন্য মেরামত করার প্রয়োজন মনে করেন। এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধান থেকে সকল কালাকানুন বাতিল করা এবং রাষ্ট্রকে সকল মানুষের জন্য বসবাসের উপযোগী করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জোটের নেতৃবৃন্দের এ ধরনের বক্তব্য শোনার পর যে কারো মনে হতে পারে যে, আমরা সত্যি সত্যি একটা ভাঙ্গাচোরা রাষ্ট্রে এখন বসবাস করছি। এমন রাষ্ট্রে আমাদের কারোই জীবনের নিরাপত্তা নেই; বসবাসের সুযোগ নেই! বাস্তবে কি আমরা কেউ বাংলাদেশে এখন এতটা অনিরাপদ? জীবনের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি? তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তাদের রাজনীতি এভাবে  প্রচার করছেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গত ১২-১৩ বছরে  বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কতোখানি স্বাবলম্বীতার দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, সে সম্পর্কে বিশে^র মর্যাদা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের যে মর্যাদা দিয়েছে তা সকলেই অবহিত। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর চল্লিশতম অর্থনৈতিক দেশে উন্নীত হয়েছে। আমরা নিজেরাই গ্রাম ও শহরে মানুষের জীবন ব্যবস্থার মধ্যে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে তার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সুফলভোগী। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশর দ্রুত পরিবর্তনশীলতার স্বীকৃতি দেশীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রায়ই দেয়া হচ্ছে। এরপরও বিএনপি এবং আমাদের ছোট ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা শুনলে মনে হয় রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের জ্ঞান পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সে কারণে তারা এখন রাষ্ট্র মেরামত তত্ত্ব হাজির করতে চাচ্ছেন। কারণ তাদের দৃষ্টিতে আমাদের রাষ্ট্রটা ভেঙেচুরে ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ আমরা ১৭ কোটি মানুষ তিন বেলা খেয়ে পড়ে আমাদের ভালোই চলছে, সবাই কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছে, দেশের আনাচে-কানাচে মানুষের নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে, মাঠে ফসল ফলানো হচ্ছে যন্ত্র প্রযুক্তির সাহায্যে, ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা ধরনের মাঝারি ও ছোট শিল্প, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে, বিদ্যুতের আলো জ্বলছে, সেখানেও শিশুদের পোশাক খাবার দাবারে আগের চাইতে ঢের পরিবর্তন ও উন্নতি এসেছে। গ্রামকে এখন আর আগের গ্রামের চোখে দেখা যায় না শহরের পরিবেশ গ্রামেও প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই লক্ষ্য করা যায়। জীবন যাত্রার মান সেখানে এখন শহরের মতই দ্রুত বর্ধনশীল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এত দ্রুত এভাবে পরিবর্তিত হবে সেটি কেউ পনের বিশ বছর আগে কল্পণাও করতে পারেনি। আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছুই এখন গ্রামে ও শহরে প্রায় সমান ভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যখন লক্ষণীয় পরিবর্তন চলছে তখন যারা এর উপর মেরামত করার কথা বলছেন তাদের রাষ্ট্র কারিগরি জ্ঞানটা বোধহয় আমাদের জেনে নিতে হবে। কারণ রাষ্ট্র মেরামত করার জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মেরামতকারী দরকার। রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর হতে পারেন একমাত্র সেই রাজনীতিবিদ যিনি রাষ্ট্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত থাকেন। রাষ্ট্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা ব্যতীত কোন রাজনীতিবিদ নতুন করে রাষ্ট্র যন্ত্র মেরামত করার কথা প্রকাশ্যে এভাবে বলতে পারেন না। রাষ্ট্র মেরামত এতো ঠুনকো ব্যাপার নয়। পৃথিবীতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে ছয় হাজার বছর আগে। ছয় হাজার বছর আগের রাষ্ট্র বহু আগেই পরিবর্তিত হয়ে এখন আধুনিক রাষ্ট্রে নির্মিত হচ্ছে। সেগুলো নির্মাণের জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রপিতা এবং তার অনুসারীদের দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, মেধা, দেশপ্রেম, সৃজনশীলতা ইত্যাদির প্রয়োগ ধারাবাহিক ভাবে চলে এসেছে।

পৃথিবীর উন্নত আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস স্বাধীনতা এবং শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে। ধারাবাহিকভাবে কারো লেগেছে তিন শতাধিক বছর; কারোবা দেড়- দুইশত বছরের বিকাশমান প্রক্রিয়ায় রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নির্মাণের ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরছে; সে অভিজ্ঞতা একেক দেশের একেক রকম। কোন রাষ্ট্র হুবহু অন্যকে নকল করে চলেনি চলছেও না। ভাঙ্গা-গড়ার ভেতর দিয়ে অনেক রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেই দাঁড়ানো কারো জন্যই সহজ কাজ ছিল না। এর কৃতিত্ব ছিল ঐসব রাষ্ট্রের অসংখ্য মেধাবী, যোগ্য এবং দূরদর্শী রাষ্ট্র নির্মানের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ রাষ্ট্র নায়কদের।

এই ইতিহাস পৃথিবীতে এখন সর্বত্র গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পাঠ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে রাজনীতিতে এখন অনেকেই রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলেন, তত্ত্ব দেয়ার চেষ্টা করেন,  অনেকে তরুণদের মাথা গুলিয়ে ফেলার মত রাষ্ট্রতত্ত্ব দেয়ার চেষ্টা করেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া বেশ কিছু রাজনীতিবিদ। তাঁরা সম্মিলিত ভাবেই আমাদের জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই অনেকেই নতুন রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেন। সিরাজুল আলম খান বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব উত্থাপন করে  তরুণদের একটি বড় অংশকে বিভ্রান্ত করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে আগে গড়ে তোলার পর্ব না সারতেই  সিরাজুল আলম খান এবং তার অনুসারীরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নানা কথা বাজারে ছেড়ে দিলেন। সংসদ শুয়োরের খোঁয়াড়, বাংলাদেশকে বললেন বুর্জোয়া রাষ্ট্র, এটিকে ভাঙতে হবে, গড়তে হবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র যার জন্য দরকার বিপ্লব। বিপ্লব মানে তাদের ভাষায় পুরাতন রাষ্ট্রকে ভাঙ্গো গড়ো নতুন রাষ্ট্র- এ যেন পুতুল খেলা! রাষ্ট্র সম্পর্কে এমন অবাস্তব তত্ত্বের অন্যতম অনুসারি হচ্ছেন আ স ম আব্দুর রব এত বছরেও তিনি এ রাষ্ট্রের একটি খুঁটি নাড়তে পারেননি গাড়তেও পারেননি।

শুধু তিনি কেন সিরাজ সিকদার, আলাউদ্দিন, হক তোহায়া, মাওলানা ভাসানীসহ আরো অনেকেই নতুন নতুন রাষ্ট্র তত্ত্ব’র কথা আমাদের কে শুনিয়েছিলেন। এখন মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি, সাইফুল হকও নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের কথা বলছেন। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন মির্জা ফখরুলও। কিন্তু এইসব রাষ্ট্র তত্ত্ব অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য এবং মানুষকে বোকা বানানোর ফন্দিফিকির ছাড়া আর কিছু নয়। সেটি রাজনীতি সম্পর্কে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা তো বুঝেনই, সাধারণ মানুষও কমবেশী বুঝতে পারেন।

স্বাধীনতার পর আমাদের রাষ্ট্র নির্মাণের যাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রের জন্য তিনি প্রথমেই দিলেন সংবিধান। সংবিধানে রাষ্ট্রের চারটি মূল স্তম্ভ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই সব স্তম্ভের উপর একটি শোষণহীন সোনার বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে ছিলেন। তার জন্য তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন যার ভিত্তিতে দেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি একটি আধুনিক জাতি গঠনের জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন; শিক্ষা নীতির উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকরা সুশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত এবং দেশপ্রেমে দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আধুনিক রাষ্ট্রের মর্যাদা দান করবে। বঙ্গবন্ধু সেই পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর সেই রাষ্ট্রের স্তম্ভের উপর বড় ধরনের বুলডোজার চালিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক-জিয়াউর রহমান-এরশাদ। বিএনপি এবং সেই রাজনীতির অনুসারী দল ও ব্যক্তিরা পঁচাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্র ভাঙ্গার রাজনীতি করেছে।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ৭২’র সংবিধানের ধারায় ভাঙ্গা রাষ্ট্র নির্মাণের হাত দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে আবার সেই রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আসলেন তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাষ্ট্রে পরিণত করার মিশন বাস্তবায়ন করছিল। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা পুনরায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাণের কঠিন কাজটি হাতে তুলে নিলেন। ১৩ বছরে তিনি বাংলাদেশটাকে পৃথিবীর চল্লিশতম রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সক্ষম রাষ্ট্রটিকে যারা ভাঙতে চাচ্ছে তারা আবার বাংলাদেশকে পঁচাত্তর পরবর্তী ভাঙ্গনের আবর্তে এনে ফেলে দিতে চাচ্ছেন। এখন যারা রাষ্ট্র মেরামত তত্ত্বের বাঁশি মুখে তুলে নিয়েছেন তারা আসলে ওই হ্যামিলনের বংশীবাদকের দল যারা আমাদেরকে গল্পের শিশুদের মতো নদীতে নিক্ষেপ করে মারতে চাচ্ছে। সুতরাং রাষ্ট্র নির্মাতা নয় বরং রাষ্ট্রের ধ্বংসের পথেই তারা আমাদেরকে পরিচালিত করতে চাচ্ছে। আমরা নিশ্চয়ই এতটা বোকা নই। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের চোখে অতটা বড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নন যতটা তারা নিজেদেরকে মনে করেন। 
 লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়