জাকির তালুকদার: ১. যারা বলেন শাহবাগ জাতিকে বিভক্ত করেছে, তারা হয় অজ্ঞ, নয়তো মিথ্যাবাদী। জাতি আগে থেকেই বিভক্ত। এমনকি একাত্তরও জাতিকে এক করতে পারেনি। ২. শাহবাগ শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিপক্ষতা দিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে অসম আইন তৈরি করা হয়েছিল, তা একদল সচেতন মানুষকে শুরু থেকেই সন্দিহান করেছিল। আসামীপক্ষ আপিল করতে পারবে, অথচ বাদীপক্ষ পারবে না, এমন উদ্ভট ক্লজ থাকে কী করে?
আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিল বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরাট অংশের নৈতিক মান নিয়ে প্রশ্ন বরাবরই ছিল। শেখ হাসিনাও বলেছেন, আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়। তো যুদ্ধাপরাধীদের কাছে তারা যে বিক্রি হতে পারে, সেই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছিল ক্রমেই। কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা এবং তার ভি চিহ্ন দেখানো সেই সন্দহকে সত্যতার রূপ হিসাবে প্রতিভাত করে। তাৎক্ষণিকভাবে শাহবাগে জড়ো হন কিছু প্রতিবাদী মানুষ।
যারা মনে রাখতে চান না, বা ভুলে যেতে ভালোবাসেন, তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, এমনকি তোফায়েল আহমদকেও দুয়ো দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল প্রথম জমায়েতকারীরা।
পরবর্তীতে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো কিছু ব্যক্তিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ শাহবাগ আন্দোলনের কর্তৃত্ব দখল করে নেয়। আর প্রথম ভুল ছিল ইমরান এইচ সরকারকে মুখপাত্র নির্বাচন করা, যে কিনা আগে থেকেই আওয়ামী লীগের প্রচার সেলের সদস্য। ভুলটা হয়েছিল লীগে ইমরানের লো প্রোফাইল অবস্থানের কারণে। ৩. ট্রাইবুনালের আইন সংশোধনের পর শাহবাগ আন্দোলন উইথ ড্র করা উচিত ছিল অবিলম্বে। কিন্তু কারিশমার মোহে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অনির্দিষ্ট কাল চালাতে গিয়ে সরকার তো বটেই, সাধারণ ঢাকাবাসী মানুষেরও বিরক্তি উৎপাদন করেছিল।
৪. শুরু থেকেই ফরহাদ মজহার ও তার গ্রুপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সলিমুল্লাহ খান সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পরে জানা যায়, কারণগুলির মধ্যে একটি অন্তত ছিল নিতান্তই পারিবারিক স্বার্থ। তার ছোটভাই সাদতউল্লাহ খান কক্সবাজারে একটি আসনে নৌকার মনোনয়ন কামনা করছিলেন ২০১৪-র সংসদ নির্বাচনে। ভ্রাতার সুবিধার্থে ভাই তো কিছু করতেই পারে।
৫. বিএনপি এবং ছাত্রদল শাহবাগে অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে দোদুল্যমান ছিল। তাদের কোনো কোনো নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শাহবাগে গিয়েছিলেন। টিভির বিভিন্ন টক শো-তে শাহবাগ সম্পর্কে ইতিবাচক কথাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর গিয়ে পুত্র এবং কারো কারো সাথে মিটিং সেরে দেশে ফিরে বললেন, শাহবাগীরা 'দুষ্ট ছেলে'।
৬. ফরহাদ মজহার এবং বিএনপি-জামাতের শত নাগরিক কমিটি শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ইসলামি আলেম বলে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তারা ইসলাম ধ্বংস করার চক্রান্ত হিসাবে দেখতে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। সেই কাজকে সহজতর করে দিয়েছিল কিছু নাস্তিক্যবাদির (কমিউনিস্ট নয়) বল্গাহীন মোল্লাখেপানো বক্তব্য।
৭. হেফাজতকে ব্যবহার করা হলো শাহবাগ আন্দোলন ভাঙার জন্য। কোত্থেকে রাতারাতি জন্ম হলো হেফাজতের? মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিপুণভাবে কোনো বিশাল সমাবেশ সংঘটিত হতে পারে কেবল সরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ ও অর্থায়নে। সেটাই ঘটেছে হেফাজতের উত্থানের পেছনে। আই ওয়াশ হিসাবে তাদের কয়েক বেলার জন্য আটকে রাখা হয়েছিল ময়মনসিংহ, সিলেটসহ কিছু জায়গাতে। কিন্তু রাতের বেলা ঠিকই শত শত বাস পাঠিয়ে আনা হয়েছিল তাদের ঢাকার উপকণ্ঠে। মওলানা শফী ঢাকায় এসেছিলেন সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের হেলিকপ্টারে। শাহবাগ ছেড়ে চলে গেল ছাত্রলীগ। উঠে গেল তিন স্তরের পুলিশি নিরাপত্তা।
৫. তাহলে ৫ই আগস্ট রাতে হেফাজতকে শাপলা চত্বর থেকে ওভাবে তাড়ানো হলো কেন? কারণ শাহবাগের নেতাদের মতো হেফাজতের নেতারাও লিমিট ক্রস করে ফেলেছিলেন। সড়কের হাজার হাজার গাছ কাটা, জ্বালানো-পোড়ানো, জামাত-শিবিরের ক্যাডারদের যথেচ্ছ ধ্বংসকাণ্ড চালাতে দেওয়া, সমাবেশ শেষে কথামতো শাপলা চত্বর ছেড়ে না গিয়ে সেখানে খুঁটি গেড়ে বসা-- এসব পছন্দ হয়নি সরকারের। ফলাফল শাহবাগ ঠাণ্ডা, হেফাজত ঠাণ্ডাÑ সরকারের ডবল লাভ। লাভের ওপর লাভ। ফেসবুক থেকে
লেখক: কথাসাহিত্যিক।