অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: মাশা আমিনা। মাত্র ২২ বছরের ইরানি মেয়ে। সে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কুর্দিস্তান থেকে ইরানির রাজধানী তেহরানে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যায়। সেখানে হিজাব না পড়ার দায়ে ইরানের মোরালিটি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান যে মাশা আমিনীকে গ্রেফতার করে পুলিশ ভেনে উঠিয়েই তাকে মারতে শুরু করে। ইরানে নারীদের হিজাব পড়ার ওপর আরো কড়াকড়ি আরোপের জন্য ইরানের প্রেসিডেন্টের আহ্বানের এক সপ্তাহের মধ্যে মাশা আমিনীকে গ্রেফতার করা হয়। আমিনীকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয় যে গ্রেফতারের ১ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে হাসপাতালে নিতে হয় এবং সেখান থেকে ওঈট-তে যেখানে তার মৃত্যু হয়।
মাশা আমিনীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানে এখন হিজাব বিরোধী আন্দলোন শুরু হয়েছে। মেয়েরা দলে দলে উৎসবের সাথে হিজাব পুড়িয়ে ফেলছে। এই প্রসঙ্গে একটা সত্যি ঘটনা বলি। আমি যখন পিএইচডি করি তখন আমার সুপার ভাইসজরের সাথে পিএইচডি করতে ইরান থেকে একজন মেয়ে আসে। আমার সুপারভাইজার আমিসহ আরেকজনকে হিথ্রো বিমানবন্দরে পাঠিয়েছিল ওকে রিসিভ করতে। আমার সুপারভাইজরের ধারণা ছিল ইরানের মেয়ে বলে ও খুব সহজ সরল অবলা মেয়ে হবে। সে যখন ইমিগ্রেশন পার হয়ে বের হয়ে আসলো এসেই দেখি ওর বোরখা ও হিজাব খুলে ফেলে এবং দেখলাম বোরখার নিচে স্কার্ট এবং পশ্চিমা ড্রেস পড়া। তারপর সে জিজ্ঞেস করছিল বিন কোথায়। সেখানে সে বোরখা ও হিজাব ফেলে দিয়েছিল আর কোনদিন তাকে ওসব পড়তে দেখিনি। সে আর ইরানেও ফিরে যায়নি। খুবই বুদ্ধিমতী এবং চালাক মেয়ে ছিল সে। লন্ডনে এসে কিছুদিনের মধ্যেই ভাইজার পরিবর্তন করে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স করতে অন্য একজনের সাথে সাথে পিএইচডি করতে চলে যায়। পরবর্তীতে তার সাথে সম্পর্কও হয়। তারপর আর জানিনা কি হয়েছে। শুনেছি এখন সে স্থায়ীভাবে লন্ডনে আছে।
মনে আছে Reyhaneh Jabbari-র কথা? যেই মানুষটি তাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল তা থেকে রক্ষার জন্য হাতের কাছে একটি ছুরি পেয়ে সেটা দিয়ে stab করলে সেই ধর্ষক মারা যায়। ইরানিয়ান কোর্ট সেই মৃত্যুকে আত্ম রক্ষা বা সম্ভ্রম রক্ষা হিসাবে না দেখে খুন হিসাবে দেখে রেহানেহকে ফাঁসির আদেশ দেয়। ইরানসহ সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ সত্বেও ইরান সরকার ২০১৪ সালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলে। অর্থাৎ ধর্ষকরা ধর্ষণ করতে যাবে কিন্তু নারীরা তা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারবে না।
এইজন্যই ইরান থেকে কোন নারী একবার বের হতে পারলে সে আর কোনদিন সহজে ইরানে ফিরে যেতে চায় না। ইরানের মারিয়াম মির্জাখানি দুইবার গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক পায়। উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় গিয়ে সেও ফিরে যায়নি। সে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন এবং পরে ক্যান্সারে মারা যান। এই কথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। আমাদের মেয়েরা একবার আমেরিকায় যেতে পারলে সহজে ফিরে আসতে চায় না। এইরকম উদাহরণ আমি অনেক দেখেছি। কারণ দিন দিন এই দেশ মেয়েদের জন্য দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। জন্ম থেকে মেয়েদের শুনতে হয় খেলতে যেতে পারবে না, ছেলেদের সাথে মিশতে পারবে না, রাতে বাহিরে থাকতে পারবে না, ওরকম ড্রেস পড়তে পারবে না। এত রেস্ট্রিকশন যদি পুরুষদের ওপরে আরোপ করা হতো? এমনিতেই রাষ্ট্র কর্তৃক কথার স্বাধীনতা কম। তার উপর ধর্মের কারণে আরো অনেক স্বাধীনতাও যদি পুরুষদের অবস্থা মেয়েদের মত হতো তাহলে আমরা কি আমাদের মেধার উম্মেষ ঘটাতে পারতাম?
এই যে আমাদের মেয়েরা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলো তারা কি পারতো যদি তারা সকল রেস্ট্রিকশন মেনে চলত। তারা মানেনি। সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। একজন নেপালি নারী ফুটবলারের চেয়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের অনেক বেশি বাধা অতিক্রম করে খেলতে হয়েছে। এইসব বাধার মধ্যে আরেকটি বাধা ছিল আর্থিক অস্বচ্ছলতা। একটি দেশের নারী পুরুষ যদি সমানভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশ না পায় সেই দেশ কখনোই উন্নত হবে না।
লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়