এশিয়া টাইমস: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে তাঁর ৭৫তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তাঁদের কথোপকথনকে ‘অদ্ভুত সুন্দর’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এই কথোপকথন আশা জাগিয়েছিল যে গত ২৭ আগস্ট ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের জের ধরে দুই দেশের মধ্যে চলা উত্তেজনা কমতে পারে।
কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের নরম ভাব মাত্র তিন দিনের মধ্যেই উবে যায়। ১৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে এইচ–১বি ভিসার জন্য বার্ষিক এক লাখ ডলার ফি আরোপ করেন, যার ৭০ শতাংশই ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর পাশাপাশি ট্রাম্প চাবাহার বন্দরের ইরানি প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধা বাতিল করেন। এ ছাড়া ট্রাম্প ভারতকে ‘মুখ্য মাদক পরিবহন বা অবৈধ মাদক উৎপাদনকারী দেশ’–এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর কয়েক দিনের মধ্যে ট্রাম্পের নেওয়া এসব ঘোষণা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বিস্মিত করেছে। লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী এটিকে মোদির ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ট্রাম্প ভারতকে প্রলোভন দেখিয়েছেন—আমেরিকার উৎপাদন চীন থেকে ভারতের দিকে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু তিনি চুপিচুপি ভারতের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছেন এবং ভারতের ওপর ইরান থেকে তেল আমদানি কমানোর চাপ দিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, যেসব পদক্ষেপ ট্রাম্প নিয়েছেন, সেগুলো কি তিনি ব্যক্তিগতভাবে মোদিকে আঘাত করার জন্য নিয়েছেন? নাকি এগুলো ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুযায়ী ভারতকে বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়ে ছাড় দিতে বাধ্য করার কৌশল?
তবে যেভাবেই হোক, এই ঘটনাগুলো দেখাচ্ছে, ভারত আমেরিকার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। এটি দিল্লির কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
ট্রাম্পের কৌশল এখন অনেকের কাছে পরিচিত। তাঁর কূটনীতির ধরন হলো—প্রথমে প্রশংসা, তারপর হঠাৎ চাপ। এটি ‘ভালো পুলিশ, খারাপ পুলিশ’ ধাঁচের মতো। এটি প্রশংসা দিয়ে শুরু হয় এবং হঠাৎ চমক দিয়ে শেষ হয়। এতে অপর পক্ষ সব সময় অসুবিধায় থাকে এবং সন্তুষ্ট করতে আগ্রহী হয়।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কেও এই ধরন দেখা গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ—২০১৯ সালে টেক্সাসে ‘হাউডি মোদি’ এবং পরের বছর মোদির রাজ্য গুজরাটে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ দেখা গেছে। ওই সময় দুই নেতাই একে অপরের প্রশংসায় উদ্দীপ্ত ছিলেন।
ট্রাম্প ভারতকে প্রলোভন দেখিয়েছেন—আমেরিকার উৎপাদন চীন থেকে ভারতের দিকে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু তিনি চুপিচুপি ভারতের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছেন এবং ভারতের ওপর ইরান থেকে তেল আমদানি কমানোর চাপ দিয়েছেন।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে একই ঘটনা আবারও ঘটেছে। আগস্টের শেষের দিকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এটিকে মূলত ভারতের সস্তা রাশিয়ান তেল কেনার জন্য ‘শাস্তি’ হিসেবে ধরা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর জন্মদিনের উষ্ণ শুভেচ্ছা জানানোর পর ১৯ সেপ্টেম্বর এইচ–১বি ভিসার ফি বাড়ানো, চাবাহার বন্দরের বিশেষ সুবিধা বাতিল এবং ভারতকে মাদক পরিবহনকারী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার মতো তিনটি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এইচ–১বি ভিসার এক লাখ ডলারের ফির কথা ভাবুন। ভারতীয় নাগরিকেরা এই ভিসার প্রায় ৭৩ শতাংশ ধরে রেখেছে। এটি ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিস, ইনফোসিস এবং উইপ্রো-এর মতো কোম্পানিগুলোকে এখন অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে হবে; তাদের নতুন নিয়োগ সীমিত হবে এবং অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যের ১২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বার্ষিক রেমিট্যান্স ঝুঁকির মুখে পড়বে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়াও এই নীতি ভারতের আমেরিকান প্রবাসীদের মধ্যে মোদির জনপ্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ট্রাম্প আশা করেন, তাঁরা এসবের জন্য মোদির ওপর দোষ চাপাবেন।
চাবাহার সুবিধা বাতিল আরও তীব্র ভূরাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। ভারত ২০২৪ সালের মে মাসে ইরানের সঙ্গে ১০ বছরের পরিচালন চুক্তি স্বাক্ষর করে এই বন্দরে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে। বন্দরটি আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে, পাকিস্তানকে বাইপাস করে এবং চীনের প্রভাবকে সামলায়।
২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দেওয়া মার্কিন বিশেষ ছাড় এই প্রকল্পকে নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করেছিল। হঠাৎ সেই ছাড় বাতিলের ফলে ৫০ কোটি ডলারের ভারতীয় বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
মাদক পরিবহনকারী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্তি ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে ছায়া ফেলেছে। চীন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানসহ ২২টি দেশের সঙ্গে ভারতকে ফেন্টানাইল ও প্রিকারসর রাসায়নিকের পরিবহনকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মোদি নিজেকে যখন ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে তুলে ধরতে চান এবং ভারতকে একটি দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে চান, ঠিক সেই মুহূর্তে এই তালিকাভুক্তি দিল্লির জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠেছে।
এসব পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে দেখায় ট্রাম্প বাণিজ্য আলোচনার আগে ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে চাচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন ভারত রাশিয়ান তেল আমদানি কমাক (যা বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও ভারতের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে) এবং আমেরিকার পণ্য ও সেবা ভারতে ঢোকার ক্ষেত্রে বাধা কমাক।
ভারত এখনো রাশিয়ান অস্ত্র ও শক্তির ওপর নির্ভরশীল। ভারত এখনো ব্রিকস+ দেশগুলোর মাধ্যমে ডলারহীন বাণিজ্য করছে। চাপ বাড়িয়ে ট্রাম্প ভারতের এই সুবিধা সীমিত করতে চাইছেন।
ভারতের এই সমস্যার মূল কারণ হলো: যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অস্বাস্থ্যকর নির্ভরতা। এটি তার পররাষ্ট্রনীতিকে বিকৃত করেছে। আর এই ভুলের কেন্দ্রে আছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
জয়শঙ্কর ২০০৭ সালে দিল্লির ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন।
২০১৯ সালে জয়শঙ্করের পদোন্নতির পর এই নীতি পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। ভারত চারটি মৌলিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এটি তাকে ওয়াশিংটনের কৌশলগত জালে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ফেলে।
ওবামা যুগের ‘এশিয়ার দিকে নজর ফেরানো’ নীতি অনুযায়ী, ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত শক্তি হিসেবে দেখা হয়েছিল। ভারত ভেবেছিল, আমেরিকা চীনের মতো তাকে বাজারে সুবিধা, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বিনিয়োগ দেবে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হলো। আমেরিকা কখনো এই সুবিধা দেয়নি। বরং মুক্তবাণিজ্য আলোচনা আটকে গেছে। চীনের প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণে ২০২০ সালে ভারত আরসিইপি থেকে সরে আসে, কিন্তু আমেরিকা তার বিনিময়ে কোনো বিকল্প সুবিধা দেয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনাও ধীর হয়ে যায়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আমেরিকা সুরক্ষা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যেটিকে ভারত প্রথম থেকে গুরুত্ব দেয়নি।
এর ফল হিসেবে ভারতের কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা হয়নি। বরং তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্কিন ঘনিষ্ঠতা ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের সময় চীনের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়েছে, কারণ বেইজিং ভারতকে মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে দেখেছিল।
এতেও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করেনি এবং আরও ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়েছে। ট্রাম্প ভারতে কারখানা স্থানান্তরের প্রলোভন দেখালেও, জেনারেল মোটরস, ফোর্ড ও হারলে-ডেভিডসন বড় কোম্পানিগুলো একই সময়ে ভারত থেকে বেরিয়ে গেছে।
এখন সময় এসেছে ভারতের জন্য সাহসী কৌশলগত পথ তৈরি করার। ভারতকে এখনই আত্মনির্ভরতার পথে হাঁটার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
ভীম ভুর্তেল নেপালি লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ
অনুবাদ: প্রথম আলো