আধুনিক জীবনযাত্রায় কিডনি ও পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি দশজনে একজনের কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি থাকে এবং নারীদের মধ্যে পিত্তথলির পাথরের সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। মূলত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং অপর্যাপ্ত পানি পানের মতো সাধারণ কিছু কারণেই এই জটিল রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। তবে সচেতন থাকলে এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে এই সমস্যা অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কিডনির পাথর কী?
কিডনি আমাদের শরীরের ছাঁকনির মতো কাজ করে। এটি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি ছেঁকে মূত্র হিসেবে বের করে দেয়। যখন মূত্রে খনিজ ও লবণের (যেমন: ক্যালসিয়াম, অক্সালেট, ইউরিক অ্যাসিড) ঘনত্ব খুব বেশি হয়ে যায়, তখন সেগুলো জমে ছোট ছোট কঠিন স্ফটিক বা পাথরের আকার ধারণ করে। এই পাথরগুলো কিডনির ভেতরে বা মূত্রনালির যেকোনো অংশে তৈরি হতে পারে।
কেন হয় কিডনিতে পাথর?
কিডনিতে পাথর হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রধান কারণগুলো হলো:
অপর্যাপ্ত পানি পান: এটিই সবচেয়ে সাধারণ কারণ। শরীরে পানির পরিমাণ কম হলে মূত্র ঘন হয়ে যায়, ফলে খনিজ পদার্থগুলো জমে পাথর তৈরি হওয়ার সুযোগ পায়।
খাদ্যাভ্যাস:
অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার: পালংশাক, বিট, বাদাম, মিষ্টি আলু, চকোলেট, সয়াজাতীয় খাবার অতিরিক্ত খেলে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম): খাবারে বেশি লবণ খেলে মূত্রে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রাণিজ প্রোটিন: লাল মাংস, ডিম, সামুদ্রিক মাছ অতিরিক্ত খেলে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ে, যা থেকে ইউরিক অ্যাসিড পাথর হতে পারে।
স্থূলতা ও ওজন বৃদ্ধি: অতিরিক্ত ওজন কিডনির কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে এবং পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারে কারও কিডনিতে পাথর হওয়ার ইতিহাস থাকলে অন্যদেরও হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অন্যান্য শারীরিক সমস্যা: হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজম, রেনাল টিউবুলার অ্যাসিডোসিস, বারবার মূত্রনালির সংক্রমণ (UTI) এবং হজমের কিছু রোগ (যেমন: ক্রোন'স ডিজিজ) কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কিডনিতে পাথরের লক্ষণ
পাথরের আকার ছোট হলে অনেক সময় কোনো লক্ষণই দেখা যায় না এবং তা প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পাথর বড় হলে বা মূত্রনালিতে আটকে গেলে অসহনীয় যন্ত্রণা হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
কোমরের দুই পাশে বা তলপেটে তীব্র ব্যথা, যা কিছুক্ষণ পর পর আসে।
ব্যথা কোমর থেকে কুঁচকির দিকে ছড়িয়ে পড়া।
প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা।
বারবার প্রস্রাবের বেগ আসা।
গোলাপি, লাল বা বাদামী রঙের প্রস্রাব (প্রস্রাবে রক্ত)।
বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
সংক্রমণ হলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা।
পিত্তথলির পাথর কী?
পিত্তথলি বা গলব্লাডার যকৃতের নিচে অবস্থিত একটি ছোট অঙ্গ, যা পিত্তরস (Bile) জমা রাখে। এই পিত্তরস চর্বিজাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে। পিত্তরসের প্রধান উপাদানগুলোর (কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন, পিত্ত লবণ) ভারসাম্য নষ্ট হলে அவை জমে কঠিন পাথরের সৃষ্টি করে। একেই পিত্তথলির পাথর বলা হয়।
কেন হয় পিত্তথলিতে পাথর?
পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
কোলেস্টেরলের আধিক্য: পিত্তরসে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকলে তা জমে গিয়ে হলুদ-সবুজ রঙের কোলেস্টেরল পাথর তৈরি করে, যা সবচেয়ে সাধারণ।
বিলিরুবিনের আধিক্য: যকৃতের সমস্যা, লিভার সিরোসিস বা রক্তের কিছু রোগের কারণে পিত্তরসে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে পিগমেন্ট পাথর তৈরি হয়।
পিত্তথলির কার্যকারিতা কমে যাওয়া: যদি পিত্তথলি ঠিকমতো সংকুচিত হয়ে পিত্তরস নিঃসরণ করতে না পারে, তবে পিত্তরস ঘন হয়ে পাথর তৈরি হতে পারে।
অন্যান্য ঝুঁকি:
লিঙ্গ ও বয়স: ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে এই ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন পিত্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
দ্রুত ওজন কমানো: খুব দ্রুত ওজন কমালে যকৃত অতিরিক্ত কোলেস্টেরল নিঃসরণ করে, যা পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ চর্বি ও উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত এবং কম ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া।
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা: দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকলে পিত্তরস ঘন হয়ে যায়, যা থেকে পাথর হতে পারে।
পিত্তথলিতে পাথরের লক্ষণ
অনেকের ক্ষেত্রেই পিত্তথলির পাথর কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না (Silent Stones)। তবে পাথর পিত্তনালিতে আটকে গেলে তীব্র ব্যথা হতে পারে, যাকে ‘গলব্লাডার অ্যাটাক’ বলা হয়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
পেটের উপরের ডান দিকে বা বুকের মাঝখানে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা শুরু হওয়া।
ব্যথা কাঁধের দিকে বা পিঠের ডান দিকে ছড়িয়ে পড়া।
তৈলাক্ত বা ভারী খাবার খাওয়ার পর ব্যথা বেড়ে যাওয়া।
বমি বা বমি বমি ভাব।
বদহজম ও পেট ফাঁপা।
জন্ডিস (ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া), গাঢ় রঙের প্রস্রাব এবং ফ্যাকাশে মল (যদি পাথর পিত্তনালি পুরোপুরি আটকে দেয়)।
কিডনি বা পিত্তথলির পাথর চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম। কিছু নিয়ম মেনে চললে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন:
এটি কিডনির পাথর প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। দিনে অন্তত ৩-৪ লিটার (১০-১২ গ্লাস) পানি পান করুন। এতে প্রস্রাব পাতলা থাকে এবং খনিজ পদার্থ জমে পাথর তৈরি হতে পারে না।
২. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন:
স্থূলতা উভয় প্রকার পাথরের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। তবে খুব দ্রুত ওজন কমানো থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার কারণ হতে পারে।
৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন:
কিডনির পাথরের জন্য:
লবণ কম খান: পাতে আলাদা লবণ এবং প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
অক্সালেটযুক্ত খাবার পরিমিত খান: যাদের ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথরের প্রবণতা আছে, তারা পালংশাক, বিট, বাদাম ইত্যাদি পরিমিত পরিমাণে খান।
প্রাণিজ প্রোটিন কমান: লাল মাংসের পরিবর্তে মাছ বা উদ্ভিজ্জ প্রোটিন (ডাল, মটরশুঁটি) বেছে নিন।
লেবু জাতীয় ফল খান: লেবু, কমলা, বাতাবি লেবুতে থাকা সাইট্রেট কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পিত্তথলির পাথরের জন্য:
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট গ্রহণ করুন: সম্পৃক্ত চর্বি (Saturated Fat) যেমন—ঘি, মাখন, ডালডা, লাল মাংসের চর্বি এড়িয়ে চলুন। এর পরিবর্তে অসম্পৃক্ত চর্বি (Unsaturated Fat) যেমন—অলিভ অয়েল, বাদাম, অ্যাভোকাডো, ওমেগা-৩ যুক্ত মাছ খান।
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খান: ফল, শাকসবজি, শস্যদানা, ওটস ইত্যাদি আঁশযুক্ত খাবার কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং হজমে সাহায্য করে।
খাবার বাদ দেবেন না: বিশেষ করে সকালের নাশতা বাদ দেবেন না। দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকা পিত্তথলির জন্য ক্ষতিকর।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
যাদের একবার পাথর হয়েছে বা পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসক নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ বা পথ্য তালিকা দিয়ে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারেন।
কিডনি ও পিত্তথলির পাথর একটি কষ্টদায়ক রোগ হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক জীবনযাত্রা, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং পর্যাপ্ত পানি পানের মতো সহজ কিছু অভ্যাস রপ্ত করতে পারলেই এই ঝুঁকি থেকে বহুলাংশে মুক্ত থাকা সম্ভব। যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সূত্র:
National Institute of Diabetes and Digestive and Kidney Diseases (NIDDK), USA. - "Kidney Stones" & "Gallstones" fact sheets.
Mayo Clinic, USA. - "Kidney stones - Symptoms and causes" & "Gallstones - Symptoms and causes".
NHS (National Health Service), UK. - "Kidney stones" & "Gallstones" health guides.
Johns Hopkins Medicine. - Health Library on Digestive and Kidney Diseases.