হার্ট অ্যাটাক এখন আর শুধু বয়স্কদের রোগ নয়। জীবনযাত্রার অনিয়ম, খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা এবং লাগামছাড়া মানসিক চাপের কারণে তরুণ প্রজন্মও ক্রমেই এই জীবনঘাতী সমস্যার শিকার হচ্ছে। হৃদরোগকে প্রায়শই ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়, কারণ এর অনেক লক্ষণই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের শরীর অনেক বড় বিপদ ঘটার আগেই ছোট ছোট সংকেত পাঠাতে শুরু করে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংকেত প্রকাশ পেতে পারে আমাদের নখে।
আমাদের হাতের নখ কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেনের মাত্রার যেকোনো পরিবর্তন নখের রঙ এবং গঠনে প্রভাব ফেলে। তাই নখের কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন হার্টের সমস্যার আগাম সতর্কবার্তা হতে পারে।
যেসব পরিবর্তনে সতর্ক হবেন: হার্টের সঙ্গে নখের সম্পর্ক
হৃৎপিণ্ডের প্রধান কাজ হলো সারা শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে দেওয়া। যখন হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমে যায় বা রক্তনালিতে কোনো সমস্যা তৈরি হয়, তখন শরীরের প্রান্তিক অঙ্গগুলোতে, যেমন—হাতের আঙুল বা পায়ের পাতায় রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে নখের ওপর। নিচে এমন কিছু লক্ষণ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. নখের নিচে লাল বা বাদামি রেখা (Splinter Hemorrhages):
নখের নিচে চুলের মতো সরু, লালচে বা গাঢ় বাদামি উল্লম্ব রেখা দেখা দিলে তা অবহেলা করার মতো বিষয় নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘স্প্লিন্টার হেমোরেজ’ বলা হয়। এটি হৃৎপিণ্ডের একটি গুরুতর সংক্রমণ, যা ইনফেকটিভ এন্ডোকার্ডাইটিস (Infective Endocarditis)-এর লক্ষণ হতে পারে। এই রোগে হৃৎপিণ্ডের ভেতরের আস্তরণ বা ভাল্বে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে। এর ফলে সেখান থেকে ছোট ছোট রক্ত জমাট বাঁধা কণা (clots) ছুটে গিয়ে আঙুলের ক্ষুদ্র রক্তনালিতে আটকে যায় এবং এই ধরনের রেখা তৈরি করে। সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি হার্ট ফেইলিওর বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
২. নখের রঙ নীলচে হয়ে যাওয়া (Cyanosis):
যদি আপনার নখ বা নখের নিচের অংশ হালকা নীল বা বেগুনী রঙের হয়ে যায়, তবে এটি শরীরে অক্সিজেনের অভাবের স্পষ্ট লক্ষণ। এই অবস্থাকে সায়ানোসিস (Cyanosis) বলা হয়। যখন হৃৎপিণ্ড কার্যকরভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না বা ফুসফুস থেকে পর্যাপ্ত অক্সিজেনযুক্ত রক্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে ত্বক ও নখের রঙ নীলচে দেখায়। এটি কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর, পালমোনারি ডিজিজ বা জন্মগত হার্টের ত্রুটির মতো গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।
৩. নখের আকৃতির পরিবর্তন বা ফুলে ওঠা (Nail Clubbing):
যদি নখগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গোলাকার, ফোলা বা চামচের মতো বেঁকে যায় এবং আঙুলের ডগা স্ফীত হয়ে ওঠে, তবে এই অবস্থাকে নেইল ক্লাবিং (Nail Clubbing) বলা হয়। এটি সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগের ক্ষেত্রে এই লক্ষণটি প্রায়শই দেখা যায়। নখের এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়, তাই অনেকেই এটিকে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এটি হতে পারে কোনো বড় রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
৪. ফ্যাকাশে বা সাদাটে নখ (Pale or Terry's Nails):
নখের বেশিরভাগ অংশ যদি ফ্যাকাশে বা সাদা হয়ে যায় এবং শুধুমাত্র ওপরের দিকে একটি গোলাপি বা বাদামি দাগ থাকে, তবে তাকে টেরি'স নেইলস (Terry's Nails) বলা হয়। যদিও এটি বার্ধক্যের কারণেও হতে পারে, তবে এটি কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর, লিভারের সিরোসিস বা কিডনি রোগের মতো গুরুতর অসুস্থতার সঙ্গেও যুক্ত। হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমে গেলে শরীরে রক্ত সরবরাহ কমে যায়, যার ফলে নখ এমন ফ্যাকাশে দেখাতে পারে।
লক্ষণ দেখা দিলে করণীয়:
নখের এই পরিবর্তনগুলো অন্যান্য সাধারণ কারণেও হতে পারে, যেমন—আঘাত, ছত্রাকের সংক্রমণ বা পুষ্টির অভাব। তবে এটিকে কখনই সাধারণ ভেবে বসে থাকা উচিত নয়।
অবহেলা নয়: ওপরের যেকোনো এক বা একাধিক লক্ষণ দেখলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (কার্ডিওলজিস্ট বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ) পরামর্শ নিন।
সঠিক পরীক্ষা: চিকিৎসক আপনার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইসিজি (ECG), ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram), রক্ত পরীক্ষা বা বুকের এক্স-রে করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে হার্টের কার্যকারিতা এবং গঠন সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়।
সতর্কবার্তা: মনে রাখবেন, নখের এই পরিবর্তনগুলো আপনার শরীরের পাঠানো সতর্কবার্তা। একে গুরুত্ব দিলে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব, যা জীবন বাঁচাতে পারে।
হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখার সার্বিক उपाय:
কেবল নখের লক্ষণ নয়, সুস্থ জীবনযাপনের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি গোড়া থেকেই কমানো সম্ভব।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: খাদ্যতালিকা থেকে অতিরিক্ত চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং লবণ বাদ দিন। সবুজ শাকসবজি, ফল, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত মাছ (যেমন—ইলিশ, স্যামন) এবং বাদাম রাখুন।
নিয়মিত শরীরচর্চা: প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ মিনিট হাঁটুন, দৌড়ান, সাঁতার কাটুন বা যেকোনো শারীরিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকুন।
ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন: ধূমপান এবং অ্যালকোহল হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির মারাত্মক ক্ষতি করে। এগুলো সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করুন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা পছন্দের শখের জন্য সময় দিন। পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বয়স ৩০ পেরোলেই বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ, সুগার এবং লিপিড প্রোফাইল (কোলেস্টেরল) পরীক্ষা করান।
শরীরের ছোট ছোট পরিবর্তনকে অবহেলা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনার নখ হতে পারে আপনার হৃদয়ের আয়না। তাই নখের যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তনে সচেতন হন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সুস্থ ও সুরক্ষিত জীবনযাপন করুন।
সূত্র: এই প্রতিবেদনটি আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি (American Academy of Dermatology), ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক (Cleveland Clinic), ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন (British Heart Foundation) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য জার্নালে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সংকলিত।