চেহারার যত্ন নেওয়ার অংশ হিসেবে অনেকেই নাকের বাড়তি লোম নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন। এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে টুইজার বা চিমটার সাহায্যে গোড়া থেকে লোম তুলে ফেলা একটি সাধারণ অভ্যাস। এতে সাময়িকভাবে নাক পরিষ্কার ও সুন্দর মনে হলেও, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই অভ্যাসকে একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে।
নাকের লোমের গুরুত্ব:
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে। নাকের লোমও এর ব্যতিক্রম নয়। চিকিৎসকদের মতে, নাকের লোম আমাদের শ্বাসতন্ত্রের জন্য একটি প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। এর প্রধান কাজগুলো হলো:
প্রাকৃতিক ফিল্টার: আমরা যখন শ্বাস নিই, তখন বাতাসে ভাসমান ধুলো-বালি, ময়লা, পরাগরেণু এবং ক্ষতিকর জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস) নাকের লোমে আটকে যায়। এটি এই কণাগুলোকে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং শ্বাসতন্ত্রকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
আর্দ্রতা রক্ষা: নাকের লোম নিঃশ্বাসের সাথে প্রবেশ করা বাতাসকে কিছুটা আর্দ্র করে তোলে, যা ফুসফুসের জন্য উপকারী।
লোম তোলার বিপদ এবং ‘ডেঞ্জার ট্রায়াঙ্গেল’:
যখন টুইজার দিয়ে জোর করে নাকের লোম গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা হয়, তখন লোমকূপের গোড়ায় একটি ক্ষুদ্র ক্ষতের (micro-wound) সৃষ্টি হয়। নাকের ভেতরের অংশটি এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল। এই ক্ষতস্থান দিয়ে Staphylococcus-এর মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই রক্তপ্রবাহে মিশে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মুখের একটি নির্দিষ্ট অংশকে ‘ডেঞ্জার ট্রায়াঙ্গেল অব দ্য ফেস’ (Danger Triangle of the Face) বা ‘বিপজ্জনক ত্রিভুজ’ বলে থাকেন। এই ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চলটি নাকের ব্রিজ (nasal bridge) থেকে শুরু হয়ে মুখের দুই কোণ পর্যন্ত বিস্তৃত।
কেন এই অঞ্চলটি এত বিপজ্জনক?
এই অঞ্চলের শিরাগুলো (veins) সরাসরি মস্তিষ্কের গভীরে অবস্থিত ক্যাভার্নাস সাইনাস (Cavernous Sinus) নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাথে সংযুক্ত। অন্যান্য স্থানের শিরার মতো এই অঞ্চলের শিরাগুলোতে ভাল্ভ (valve) থাকে না, যা রক্তের একমুখী প্রবাহ নিশ্চিত করে। ভাল্ভ না থাকার কারণে এখানকার রক্ত উভয় দিকেই প্রবাহিত হতে পারে।
ফলে, নাকের লোম তোলার কারণে সৃষ্ট সংক্রমণ যদি রক্তে প্রবেশ করে, তবে তা বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি মস্তিষ্কের ক্যাভার্নাস সাইনাসে পৌঁছে যেতে পারে।
মারাত্মক পরিণতি কী হতে পারে?
এই সংক্রমণ মস্তিষ্কে পৌঁছালে নিম্নলিখিত মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে:
ক্যাভার্নাস সাইনাস থ্রম্বোসিস (Cavernous Sinus Thrombosis): এটি একটি জীবনঘাতী অবস্থা, যেখানে ক্যাভার্নাস সাইনাসে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলে তীব্র মাথাব্যথা, চোখ ফুলে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়া, এমনকি স্ট্রোক হতে পারে। এই রোগের মৃত্যুহারও অনেক বেশি।
মেনিনজাইটিস (Meningitis): সংক্রমণ মস্তিষ্কের আবরণে ছড়িয়ে পড়লে মেনিনজাইটিস হতে পারে, যা অত্যন্ত গুরুতর একটি রোগ।
ব্রেন অ্যাবসেস (Brain Abscess): মস্তিষ্কের ভেতরে পুঁজের সৃষ্টি হতে পারে, যা স্নায়ুতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।
যদিও এই চরম পরিস্থিতিগুলো বিরল, তবুও ঝুঁকি এড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সূত্র:
বিশ্বজুড়ে কান-নাক-গলা (ENT) বিশেষজ্ঞরা নাকের লোম তোলার বিপদের বিষয়ে সতর্ক করে থাকেন। নিউ ইয়র্কের ENT বিশেষজ্ঞ ডঃ এরিক ভয়গটের মতে, "নাকের লোম উপড়ে ফেলার ফলে ত্বকের নিচের টিস্যুতে প্রদাহ বা সেলুলাইটিস হতে পারে। যেহেতু এই অঞ্চলের শিরা মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত, তাই গুরুতর ক্ষেত্রে সংক্রমণ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ার একটি ক্ষুদ্র কিন্তু বাস্তব ঝুঁকি থেকেই যায়।"
এই বিষয়ে বিশ্বের খ্যাতনামা স্বাস্থ্য সংস্থা যেমন ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক (Cleveland Clinic), হেলথলাইন (Healthline), WebMD এবং বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত তথ্যে একই ধরনের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই একমত যে নাকের লোম উপড়ে ফেলার অভ্যাসটি বর্জন করা উচিত।
তাহলে নিরাপদ উপায় কী?
নাকের লোম পরিষ্কার রাখার জন্য সৌন্দর্য বা স্বাস্থ্য কোনোটিকেই বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য নিরাপদ বিকল্পের পরামর্শ দেন:
ট্রিমার ব্যবহার: বাজারে বিশেষভাবে নাকের লোম কাটার জন্য তৈরি ইলেকট্রিক বা ম্যানুয়াল ট্রিমার পাওয়া যায়। এগুলি লোমকে গোড়া থেকে না তুলে নিরাপদভাবে কেটে ছোট করে দেয়, ফলে কোনো ক্ষত সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে না।
ছোট কাঁচি ব্যবহার: ভোঁতা মাথার ছোট কাঁচি (rounded-tip grooming scissors) ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি দিয়ে শুধুমাত্র নাকের বাইরে বেরিয়ে আসা বাড়তি লোম সাবধানে ছেঁটে ফেলা উচিত।
উপসংহার:
সৌন্দর্যচর্চা জীবনের অংশ, কিন্তু তা যেন কখনোই স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। নাকের লোম উপড়ে ফেলার মতো একটি ছোট অভ্যাস বড় বিপদের কারণ হতে পারে। তাই টুইজার ব্যবহার না করে ট্রিমার বা নিরাপদ কাঁচির সাহায্যে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাই হলো সবচেয়ে নিরাপদ ও বুদ্ধিমানের কাজ।