আধুনিক জীবনযাত্রার কিছু সাধারণ ভুলই মেরুদণ্ডের গুরুতর সমস্যার কারণ হতে পারে। মার্কিন বিশেষজ্ঞের মতে, কয়েকটি অভ্যাস পরিবর্তন করলেই মিলবে সুস্থ ও ব্যথামুক্ত জীবন।
দেহকে সোজা রাখা, স্থিতিশীলতা দেওয়া এবং শক্তি জোগানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে মেরুদণ্ড। কিন্তু আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার নানা ভুল অভ্যাস অজান্তেই এর মারাত্মক ক্ষতি করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞ ডা. রবার্ট মানকুসোর মতে, দৈনন্দিন জীবনের কিছু সাধারণ কাজই পিঠের ওপর দীর্ঘমেয়াদী চাপ সৃষ্টি করে, যা ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
মেরুদণ্ড সুস্থ রাখতে কোন কোন অভ্যাস ত্যাগ করা জরুরি এবং তার সহজ সমাধান কী, তা জেনে নেওয়া যাক।
১. ডেস্কে দীর্ঘক্ষণ কুঁজো হয়ে বসা
সমস্যা: একটানা কুঁজো হয়ে বসে কাজ করলে কোমর ও পিঠের পেশিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এতে ‘হিপ ফ্লেক্সর’ নামক পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং মেরুদণ্ডের দুটি কশেরুকার মাঝখানে থাকা ডিস্কের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
সমাধান: চেয়ারে বসার সময় পায়ের পাতা মাটিতে সোজা করে রাখুন। মনিটর চোখের সমান উচ্চতায় রাখুন এবং পিঠ সোজা রাখার চেষ্টা করুন। প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর চেয়ার ছেড়ে উঠে হাঁটুন বা হালকা স্ট্রেচিং করুন। প্রয়োজনে পিঠের সাপোর্টের জন্য লাম্বার বালিশ ব্যবহার করতে পারেন।
২. ভুলভাবে ভারী জিনিস তোলা
সমস্যা: কোমর ঝুঁকিয়ে বা এক হাতে ভারী জিনিস তোলা, এমনকি এক হাতে শিশুকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখাও মেরুদণ্ডের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এতে মেরুদণ্ডের একদিকে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে।
সমাধান: কোনো ভারী জিনিস তোলার সময় কোমর না ঝুঁকিয়ে হাঁটু ভাঁজ করুন। এরপর বস্তুটি শরীরের কাছে এনে পায়ের শক্তি ব্যবহার করে তুলুন, পিঠের নয়।
৩. মোবাইলের দিকে দীর্ঘক্ষণ ঝুঁকে থাকা
সমস্যা: স্মার্টফোনের দিকে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলে ঘাড় এবং পিঠের ওপরের অংশে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। বিশেষজ্ঞরা এই অবস্থাকে গলায় একটি বোলিং বল ঝুলিয়ে রাখার সাথে তুলনা করেন।
সমাধান: মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় যতটা সম্ভব চোখের সমান উচ্চতায় ধরে রাখুন। নিয়মিত বিরতি নিন এবং ঘাড়ের জন্য ‘চিন টাক’ (চিবুক পেছনের দিকে টানা) ব্যায়ামটি করুন।
৪. এক কাঁধে ভারী ব্যাগ বহন করা
সমস্যা: নিয়মিত এক কাঁধে ভারী ব্যাগ নিলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এতে মেরুদণ্ড একদিকে কাত হয়ে যায় এবং কাঁধ ও পিঠের পেশিগুলোতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়।
সমাধান: ব্যাকপ্যাক ব্যবহার করলে দুটি স্ট্র্যাপই কাঁধে নিন। হাতে নেওয়ার ব্যাগ হলে নিয়মিত কাঁধ পরিবর্তন করুন এবং ব্যাগের ওজন যতটা সম্ভব হালকা রাখুন।
৫. ভুল ধরনের জুতো পরা
সমস্যা: অতিরিক্ত উঁচু হিলের জুতো বা পায়ের জন্য আরামদায়ক নয় এমন জুতো পরলে শরীরের ভঙ্গিমা বদলে যায়। এর ফলে সরাসরি পিঠ ও কোমরে চাপ পড়ে এবং ব্যথার সৃষ্টি হয়।
সমাধান: এমন জুতো পরুন যাতে পায়ের পাতার নিচের বাঁকা অংশে সাপোর্ট (আর্চ সাপোর্ট) থাকে এবং যা খুব বেশি উঁচু বা একদম সমতল নয়। হাই হিলের ব্যবহার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
৬. পেটের ওপর ভর দিয়ে ঘুমানো
সমস্যা: পেটের ওপর ভর দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমালে ঘাড় একদিকে দীর্ঘক্ষণ বাঁকা থাকে এবং মেরুদণ্ড তার স্বাভাবিক আকৃতিতে থাকতে পারে না। এটি পিঠ ব্যথার অন্যতম কারণ।
সমাধান: কাত হয়ে শুয়ে দুই হাঁটুর মাঝে একটি বালিশ রাখুন অথবা চিৎ হয়ে শুয়ে হাঁটুর নিচে একটি বালিশ দিন। এতে মেরুদণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে। ঘাড় ও মাথার জন্য আরামদায়ক বালিশ ব্যবহার করুন।
সচল থাকুন: প্রতি ঘণ্টায় অন্তত একবার উঠে দাঁড়ান বা হাঁটুন। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটা, সাঁতার বা যোগব্যায়ামের মতো হালকা ব্যায়াম করুন।
পেশি শক্তিশালী করুন: ‘কোর’ বা পেটের পেশি শক্তিশালী করতে প্ল্যাংক, গ্লুট ব্রিজ ও বার্ড-ডগ জাতীয় ব্যায়াম করুন।
সকালের স্ট্রেচিং: দিন শুরু করুন ক্যাট-কাও, কোমর মোচড়ানো বা হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচের মতো সহজ ব্যায়াম দিয়ে।
সঠিক ভঙ্গি: দাঁড়ানো বা বসার সময় মাথা উঁচু, ঘাড় লম্বা এবং কাঁধ শিথিল রাখুন।
যদি নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তবে অবহেলা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং গরম সেঁক বা স্ট্রেচিংয়েও না কমলে।
ব্যথা কোমর বা পিঠ থেকে হাত বা পায়ে ছড়িয়ে পড়লে।
শরীরের কোনো অংশে অবশ ভাব, ঝিমঝিম বা দুর্বলতা অনুভব করলে।
ব্যথার কারণে দৈনন্দিন কাজ বা ঘুম ব্যাহত হলে।
কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ওজন কমে গেলে বা রাতের বেলায় ব্যথা বেড়ে গেলে।
সূত্র: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞ ডা. রবার্ট মানকুসোর প্রতিবেদন।