এল আর বাদল : চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনো সরকারের কোনো নির্দেশনা পায়নি, কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য কমিশন নিজেরা কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে।
নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের নির্দেশনার বিষয় থাকে; তবে সব আয়োজন করতে হয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে।
এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা, আইন-বিধি-নীতিমালা সংস্কার, সংলাপ, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল, পর্যবেক্ষক নিবন্ধনসহ বেশ কিছু কাজ করতে হয়। -- সূত্র বিবিসি বাংলা
বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে সাধারণত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ প্রকাশ করে থাকে ইসি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের অন্তত দেড় বছর আগে এই রোডম্যাপ প্রকাশ করে থাকে ইসি।
তবে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে অনেক 'যদি-কিন্তু' রয়েছে। যে কারণে সাংবিধানিক কিংবা আইনি প্রশ্নগুলোর পরিবর্তে নির্বাচনের তারিখ ইস্যুতে ঐকমত্যের প্রশ্নই সামনে আসছে। আর এসব কারণে এবার নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা ও দোটানা রয়েছে খোদ নির্বাচন কমিশনের।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এখন রোডম্যাপ প্রকাশের মতো সময় এসেছি কি-না আমরা জানি না। তবে, প্রাথমিকভাবে যে সব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার সেটি আমরা নিচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এরই মধ্যে বেশ কিছু কাজের তালিকা প্রস্তুত করে তা করা হচ্ছে।
২০২৪ সালের সাতই জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে প্রায় দেড় বছর আগে ২০২২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিল বিগত হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তবে এবার সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের সময় সীমা চূড়ান্ত না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন এই রোডম্যাপ ঘোষণার দিনক্ষণ এখন চূড়ান্ত করতে পারছে না।
যদিও, গত মাসে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, তারা প্রাথমিক কাজ শেষ করে জুন- জুলাইয়ের মধ্যেই রোডম্যাপ ঘোষণা করার কথা ভাবছেন।
-- নির্বাচনি রোডম্যাপ কী? --
সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মাস খানেকের মাথায় পদত্যাগ করেন হাবিবুল আউয়ালসহ তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সব সদস্য।
নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তাদের অনেকে বলছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন দল নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা, দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালা, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটাসহ সংশ্লিষ্ট আইন-বিধি সংস্কারসহ বেশ কিছু ধাপ থাকে নির্বাচনি রোডম্যাপে।
ইসির সাবেক কর্মকর্তা ও নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, "নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন কাজ কবে, কখন কিংবা কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, সেটির একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকে নির্বাচনি রোডম্যাপে।"
তিনি বলছেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ইসির জন্যও যেমন জরুরি, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও জরুরি।
মিজ টুলীর মতে, যদি এই রোডম্যাপ আগে থেকেই না করা হয় তাহলে কোন কাজটি কত দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, সেটি নিয়ে একটি সংকট তৈরি হতে পারে ইসির জন্য।
তিনি বলেন, "সঠিক তারিখ না থাকলেও একটা কাছাকাছি ধারণা থাকতে হবে। কাজ করতে করতে একটা পর্যায়ে তারা একটা চিত্র উপস্থাপন করবে। এটাতে হেরফের হতেই পারে, তবে একটা নির্দিষ্ট টার্গেট থাকতেই হবে।
অন্যদিকে, নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য রাজনৈতিক দলের জন্যও এই রোডম্যাপ জরুরি বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
-- কী কী থাকে নির্বাচনি রোডম্যাপে?--
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১২টি পরিকল্পনা নিয়ে নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রোডম্যাপ প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রাক নির্বাচন, তফসিল পূর্ববর্তী এবং তফসিল ঘোষণার পর কী কী কর্মযজ্ঞ করবে, সেই বিষয়গুলো যুক্ত থাকে রোডম্যাপে।
এক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার আগে ভোটার তালিকা আইন-বিধি-নীতিমালা সংস্কার, সংলাপ, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল নিবন্ধন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, ভোটার তালিকার সিডি প্রকাশ, ব্যালট পেপার প্রস্তুত, নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োগসহ বেশ কিছু বিষয় যুক্ত থাকে রোডম্যাপে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "চলমান পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় অনেক সরঞ্জাম দরকার ছিল সেটা আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা ব্যালট বাক্স, কালি, স্টাম্প প্যাড, এই জিনিসগুলোর জন্য টেন্ডারিং প্রসেসে গিয়েছি। এটার জন্য টাকা লাগবে, সেই বাজেট বরাদ্দ আমরা চেয়েছি"।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বড় ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যদি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হয় তাহলে এ বছরের জানুয়ারিতে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তাদেরকে যুক্ত করা হবে ভোটার তালিকায়। আর পরের বছর জুনে ভোট হলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তারা যুক্ত হবেন তালিকায়।
এই বিশ্লেষক বলছেন, ভোটার তালিকার ওপর নির্বাচনের বড় একটি প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। কেননা ভোটার তালিকার ওপর নির্ভর করেই ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি, সীমানা চূড়ান্তসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক বড় প্রস্তুতি নিতে হয়।
তবে, এবার রোডম্যাপ ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণসহ প্রাথমিক ধাপের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছে ইসি।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কমিশন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনি কর্মপরিকল্পনা রোডম্যাপ প্রস্তুত করার সময় রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মত বিনিময় সভা, ভোটের বাজেট চূড়ান্ত, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক, রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের ব্রিফিং, নির্বাহী-বিচারিক হাকিম নিয়োগ নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুতের মতো বিষয়গুলোও যুক্ত করা হবে।