সহযোগীদের খবর: বিগ-বি উদ্যোগে বাংলাদেশকে কেন্দ্রীয় হাব হিসেবে বিবেচনা করেছে জাপান। পরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থাকবে বিদ্যমান বন্দর ও শিল্পনগরী হিসেবে। যেখানে আমদানি-রফতানির প্রবাহ বজায় থাকবে। আর মাতারবাড়ীকে পরিকল্পিত গভীর সমুদ্রবন্দর ও জ্বালানি হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়। যাতে শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ–জ্বালানি সরবরাহ এবং সমুদ্রবন্দরভিত্তিক লজিস্টিকস একসঙ্গে এগোতে পারে। এ নেটওয়ার্কে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সড়ক ও রেলপথে বাংলাদেশী বন্দর ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে সরাসরি প্রবেশের পরিকল্পনা করা হয়। সূত্র: বণিক বার্তা প্রতিবেদন
একইভাবে স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটান থেকে স্থলপথে পণ্য বাংলাদেশে এনে মাতারবাড়ী বা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রফতানি করার ভাবনাও ছিল। এতে তাদের সমুদ্রপথের খরচ ও সময় কমার কথা। পরিকল্পনায় মিয়ানমারকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী ট্রানজিট করিডোর হিসেবে ধরা হয়েছে। যাতে স্থল ও সমুদ্র সংযোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। আর থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে এ নেটওয়ার্কে ভ্যালু চেইনের ‘এক্সটেনশন’ হিসেবে এ প্রকল্পে যুক্ত করা হয়।
এক দশকেরও বেশি সময় আগে বঙ্গোপসাগর ঘিরে অর্থনৈতিক সংযোগ, বন্দর উন্নয়ন ও শিল্পায়নের লক্ষ্যে ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা ‘বিগ-বি’ প্রকল্প নিয়েছিল জাপান। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা করা এ মেগা প্রজেক্টকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিপরীতে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের কৌশলগত অবস্থানের শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। তবে উচ্চাভিলাষী এ প্রকল্প এখন জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি। ২০২২ সালে জাপানের অর্থনৈতিক মন্থরতা ও শ্রীলংকা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর এ প্রকল্পে স্থবিরতা দেখা দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি এ অঞ্চলজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কূটনৈতিক টানাপড়েন ও শাসন কাঠামোর ভঙ্গুরতায় বিগ-বি প্রকল্প ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
প্রকল্পের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কানেক্টিভিটি তৈরি ও উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করেছে জাপান। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও সংশ্লিষ্ট জ্বালানি অবকাঠামো নির্মাণকে দেশটি এ উদ্যোগের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রকল্প হিসেবে উপস্থাপন করে। ভাবা হচ্ছিল, মাতারবাড়ী শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত অঞ্চলের জন্যও নতুন বাণিজ্যিক দ্বার খুলে দেবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্প সংযোগ আরো শক্তিশালী হবে।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে তা এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে ‘হিন্টারল্যান্ড টু সি কানেক্টিভিটি’র ওপর বিগ-বি ধারণা দাঁড়িয়ে আছে, তা অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যদি কার্যকর আঞ্চলিক সহযোগিতায় রূপ না নেয়, তাহলে বিগ-বি প্রকল্প প্রায় অকার্যকর হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হক বলেন, ‘পরিবর্তিত আঞ্চলিক পরিস্থিতির কারণে বিগ-বি উদ্যোগ সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে এখন আলোচনাও নেই। তবে জাপান এ প্রকল্প থেকে সরে আসেনি। এর আবেদন ও কৌশলগত গুরুত্ব এখনো অটুট আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্প অত্যন্ত দরকার। একইভাবে ভারতের জন্যও এর বাস্তব গুরুত্ব রয়েছে। শুরুতে ভারতের আগ্রহও ছিল স্পষ্ট।’
বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘ট্যারিফ ওয়ারের (যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে) পরে ভারতের উচিত এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নেয়া। বৈরিতা বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে চিন্তা করতে হবে। যদি সমন্বিত বাজার গড়ে তোলার চিন্তা থাকে, তাহলে বিগ-বি ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপাল ও ভুটানের ক্ষেত্রে বিগ-বি পরিকল্পনার বড় বাধা তাদের অভ্যন্তরীণ নয়, করিডোর-নির্ভরতায়। দুই দেশই স্থলবেষ্টিত। বঙ্গোপসাগরে যেতে হলে তাদের পণ্য ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নিতে হয়। ফলে এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তাদের ওপরও প্রভাব ফেলে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিলে নেপাল ও ভুটানের জন্য বিগ-বি পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বিগ-বি প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ প্রকল্পের পরিকল্পনা যখন নেয়া হয়েছিল, তখন এর সম্ভাবনা ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতকে একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশকে হাব ধরে কানেক্টিভিটির ধারণা সাজানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশকে হাব হিসেবে চিন্তা করলেও প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর গুরুত্ব এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রকল্পের জন্য বড় ফ্যাক্টর। এখন দেখা যাচ্ছে জাপানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অবনতির দিকে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও টানাপড়েন চলছে, আর মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিতিশীল।’
জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কে এখনো বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি, তবে সামনে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হবে, জাপান তাতে আনকমফোর্ট ফিল করবে। বাংলাদেশকে আলাদাভাবে বিবেচনা করলেও চীনের কাউন্টার হিসেবে জাপানের বৃহত্তর স্বার্থ ও কৌশলগত গুরুত্ব ভারতের সঙ্গেই বেশি জড়িত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে চীনকে কাউন্টার করাই জাপানের বড় লক্ষ্য। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে বিগ-বি প্রকল্পের জন্য পরিস্থিতি অনুকূল নয়।’
এ প্রকল্পের জন্য আরেক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিয়ানমার। সেখানে বিগ-বি উদ্যোগের সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি হয়েছে দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা সংকটের কারণে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশজুড়ে সশস্ত্র সংঘাত, জান্তার দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রকল্প বাস্তবায়নকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। জাপানের পরিকল্পনায় মিয়ানমারকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট করিডোর হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমান বাস্তবতায় সড়ক, রেল ও বন্দরভিত্তিক সংযোগ প্রায় অসম্ভব। ফলে মিয়ানমার অংশটি কার্যত বিগ-বি নেটওয়ার্কের সবচেয়ে দুর্বল ও অনিশ্চিত লিংকে পরিণত হয়েছে।
শ্রীলংকার ক্ষেত্রে বিগ-বি উদ্যোগে বড় বাধা তৈরি করেছে দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা। ২০২২ সালে দেউলিয়া হয়ে পড়ার পর শ্রীলংকা তাদের অগ্রাধিকার পাল্টেছে। জাপানের পরিকল্পনায় বন্দর ও লজিস্টিকসের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরীয় নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ নোড হতে পারত শ্রীলংকা, কিন্তু আর্থিক সংকটের পর ঋণ পুনর্গঠন, আইএমএফের পরামর্শসহ নানা কারণে দেশটি বড় প্রকল্প থেকে পিছু হটেছে।
গবেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো অনেকটা ‘লো ইকোনমিক, পলিটিক্যাল অ্যান্ড সিকিউরিটি রেজিলিয়েন্স’-এর উদাহরণ। যেখানে শাসন কাঠামো ‘ফ্রেইল গভর্ন্যান্স ফ্রেমওয়ার্কস’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর অর্থ হলো বড় আকারের অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ধারাবাহিক নীতি ও দক্ষ প্রশাসন প্রয়োজন তা এ অঞ্চলে দুর্বল। এ বাস্তবতায় বিগ-বির মতো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকির মুখে থাকবে।
অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর ঘিরে চীনের নিজস্ব কৌশল এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিগ-বি প্রকল্পের জন্য সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। গত এক দশকে এ অঞ্চল ঘিরে চীন যে ধরনের বন্দর, জ্বালানি ও লজিস্টিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে সে প্রেক্ষাপটে বিগ-বি প্রকল্পকে অনেক বিশ্লেষকই জাপানের ‘ব্যালান্সিং স্ট্র্যাটেজি’ হিসেবে দেখেন। জাপান চেয়েছিল বঙ্গোপসাগরে একটি বিকল্প শিল্প ও কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে, যাতে অঞ্চলটি এককভাবে চীনা প্রভাবের অধীনে না যায়। কিন্তু বাস্তবে বিআরআইয়ের ব্যাপক বিস্তার বিগ-বি উদ্যোগের জন্য আরো জটিলতা তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, আঞ্চলিক অস্থিরতার প্রভাব বিগ-বি প্রকল্পে সাময়িক প্রভাব ফেললেও দীর্ঘমেয়াদে তা জাপানের জন্য বড় সংকটের কারণ হবে না। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত শাহেদ আখতার বলেন, ‘জাপানের ভিশন আছে। তারা অনেক আটঘাট বেঁধে কাজ করে। বাংলাদেশকে নিয়েও তারা অনেক রকম গবেষণা করেছে। মিয়ানমারেও তাদের অনেক বিনিয়োগ আছে; থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারতেও আছে। বাংলাদেশে নতুন নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে জাপান। সে সরকারের পরিকল্পনা তারা অনুসরণ করবে, সেভাবেই অগ্রসর হবে।’