বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, খুচরা বাজারে ক্রয়ক্ষমতার পতন এবং বাণিজ্য নীতির অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শুরুর পাঁচ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি কার্যত থমকে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য বলছে, জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়টিতে আরএমজি রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ০ দশমিক ০৯ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, প্রায় শূন্য প্রবৃদ্ধির অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রধান রফতানি খাতটি।
নিটওয়্যারে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, খানিকটা ভরসা ওভেনে এ সময়ে রফতানির ভেতরে খাতভিত্তিক পার্থক্য বেশ চোখে পড়ার মতো। নিটওয়্যার রফতানি আয় হয়েছে ৮ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ১.০০ শতাংশ কম। বিপরীতে ওভেন রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য— এই তিন বড় বাজারে ভোক্তাদের চাহিদা গত এক বছরে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শীতকালীন পণ্যের বড় একটি অংশ যেহেতু নিটওয়্যার— এ খাতে অর্ডার হ্রাস সরাসরি আয়ের ওপর চাপ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে চাহিদা ওঠানামার মধ্যেও বাংলাদেশ অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে নিটওয়্যার খাতে অর্ডার কমে যাওয়া আমাদের স্পষ্ট সতর্কবার্তা দিচ্ছে— নতুন বাজার, নতুন পণ্য এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগ ছাড়া ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে।’
নভেম্বরে বড় ধাক্কা: ৫ শতাংশ রফতানি কমেছে
২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৩.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। খাতভিত্তিক পতন ছিল— নিটওয়্যারে: ১.৬২ বিলিয়ন ডলার (৬.৮৯% হ্রাস)। ওভেনে: ১.৫২ বিলিয়ন ডলার (২.৯০% হ্রাস)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতির প্রভাব এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তবে বড় ক্রেতারা অর্ডার দিতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন, আর তার ছায়া পড়ছে বাংলাদেশের মাসিক রফতানিতে।
বিতর্কিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি: রফতানির ওপর চাপ কেন?
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের পোশাক রফতানির মন্থর গতির পেছনে কয়েকটি আন্তর্জাতিক কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এগুলো হচ্ছে- বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ও খুচরা বাজারে ধাক্কা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নতুন পোশাক কেনার প্রবণতা কমিয়ে দিয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা বড় অর্ডারের বদলে ছোট এবং সতর্ক ক্রয়ের দিকে ঝুঁকছেন।
বাণিজ্যনীতিতে অনিশ্চয়তা ও শুল্ক চাপ
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কাঠামো এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনা পোশাক বাজারে পুনর্বিন্যাস তৈরি করেছে। কিছু ব্র্যান্ড সরবরাহকারী পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, যা বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট অর্ডারেও প্রভাব ফেলছে।
প্রতীকী ছবি: কৃষিপণ্য, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও হোম টেক্সটাইলের রফতানি বেড়েছে/ফ্রিপিক
প্রায় শূন্য প্রবৃদ্ধির অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রধান রফতানি খাতটি/ফ্রিপিক
বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও সরবরাহ ব্যবস্থার খরচ বৃদ্ধি
বিশ্বব্যাপী সমুদ্রভাড়া ও কাঁচামালের দাম স্থিতিশীল না হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। অনেক ফ্যাক্টরিতে নগদ প্রবাহ সমস্যায় নতুন অর্ডার গ্রহণেও সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে।
প্রতিযোগী দেশগুলোর আগ্রাসী বাজার দখলের চেষ্টা
ভিয়েতনাম, ভারত, তুরকি এবং ইন্দোনেশিয়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপ–আমেরিকায় রফতানি বাড়াতে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। ফলে বাংলাদেশ বাজারের একটি অংশ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।
এত বাধা সত্ত্বেও কেন টিকে আছে বাংলাদেশের রফতানি?
খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুই কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। একটি হচ্ছে উন্নত কারখানা পরিবেশ ও সবুজ শিল্পের প্রসার। আর অন্যটি- প্রোডাকশন স্কেল বড় হওয়ায় খরচ প্রতিযোগিতা বজায় রাখা।
তবে তারা সতর্ক করে বলছেন, বাজারের বর্তমান স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হলে বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে।
আগামী দিনে কী দেখছেন রফতানিকারকেরা?
ব্যবসায়ীদের মতে, রফতানির গতি ফেরাতে এখনই কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ জরুরি— উন্নতমানের, উচ্চমূল্যের পণ্য বৈচিত্র্য। নতুন বাজার, বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ। উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি উন্নয়ন। লজিস্টিক খরচ কমাতে সরকারি সহায়তা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-এর সঙ্গে নীতিনির্ধারণী আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা।
সম্ভাবনার পাশাপাশি ঝুঁকিও বড়
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক অর্থনীতি আরও কয়েক মাস দুর্বল থাকতে পারে। ফলে আরএমজি রফতানি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে কি না—তা নির্ভর করবে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা, আন্তর্জাতিক শুল্কনীতি, এবং বাংলাদেশ কত দ্রুত পণ্য বৈচিত্র্যে যেতে পারে তার ওপর।
তবে ০.০৯ শতাংশের সামান্য প্রবৃদ্ধি দেখালেও খাতটি এখনো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে—যা বাংলাদেশের জন্য আশার জায়গা। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।