কক্সবাজারের টেকনাফের গহীন পাহাড়ে মানবপাচার চক্রের একাধিক ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবি। অভিযানে ওই ঘাঁটি থেকে এখন পর্যন্ত ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদেরকে পাচারের জন্য এখানে জড়ো করা হয়েছি
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান জানান, রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিজিবি ও র্যাবের সমন্বয়ে এ অভিযান শুরু হয় যা এখনও চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজারে একাধিক অভিযানে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়, যাদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য জড়ো করা হয়েছিল। আটক করা হয় মানবপাচারকারী চক্রের কয়েকটি গ্রুপের ১০ জনের বেশি সদস্যকে।
তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা, চক্রের সদস্য ও ঘাঁটি সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর রোববার দুপুর থেকে টেকনাফের রাজাছড়া গহীন পাহাড়ি এলাকা ঘিরে অভিযান শুরু করে বিজিবি ও র্যাব।
এই কর্মকর্তা বলেন, অভিযানে কয়েকটি পাহাড়ে মানবপাচার চক্রের একাধিক ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া যায়। এসব ঘাঁটি থেকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে জড়ো করা ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়।
তাদের মধ্যে যেমন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশি নাগরিকও রয়েছে। মানবপাচার চক্রের ঘাঁটিগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে ৩টি অস্ত্র উদ্ধার হয়। অভিযান এখনও চলমান রয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য টেকনাফের কচ্ছপিয়ার গহীন পাহাড়ে একটি আস্তানা থেকে নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ৬৬ জনকে উদ্ধার করে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।
তার আগে গত সপ্তাহে (১৪ সেপ্টেম্বর) সাগরপথে মিয়ানমারের ১০০ জন নাগরিককে পাচারের সময় অভিযান চালিয়ে প্রতিহত করে বিজিবি। আটক করা হয় চক্রের ৪ সদস্যকে। এরপর গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন কচ্ছপিয়া ও বরইতলি এলাকা থেকে আরও ৮ পাচারকারীকে আটক করা হয় এবং উদ্ধার করা হয় ১১ জন ভুক্তভোগীকে।
মানবপাচার চক্রের বিস্তার ও কার্যক্রম
বিজিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে থাকা এই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত পাচারকারীরা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ, আটকে রাখা এবং মুক্তিপণ আদায়ের মতো কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় গেলে পাওয়া যাবে উচ্চ বেতনের চাকরি, সহজ বিদেশযাত্রার সুযোগ এবং পরবর্তীতে আয় থেকে বিদেশে নেয়ার খরচ পরিশোধের সুযোগ। এরপর তাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে আটক রেখে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।
চক্রের গডফাদার ও নেটওয়ার্ক
বিজিবির অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে অবস্থানরত হোসেন, সাইফুল ও নিজাম নামের তিন ব্যক্তি এই আন্তর্জাতিক চক্রের মূলহোতা। তাদের অধীনে রয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত দালাল ও দস্যুদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। চক্রটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী, মাদক পাচারকারী এবং বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করছে।
বিজিবির কঠোর অবস্থান
টেকনাফস্থ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে বিজিবি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। জুলাই মাসে ১৫ জন, আগস্টে ৪ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে (এ পর্যন্ত) ১৭ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ-এই তিন দেশে বিস্তৃত এই চক্রকে দমন করতে সব বাহিনীর সমন্বয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার আহ্বান জানিয়ে লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, মানবপাচারের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে। বিদেশ যাওয়ার আগে তথ্য যাচাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৮ মাসে আটক ৬২ পাচারকারী
চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত এলাকা থেকে মোট ৬২ জন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি। ২৪ জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে। তবে চক্রের মূলহোতা এবং বাকি সদস্যদের ধরতে ভবিষ্যতে আরও অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। উৎস: সময়নিউজটিভি।