হাবিবুর রহমান সোহেল, কক্সবাজার : পর্যটন নগরী কক্সবাজার এবং পার্বত্য বান্দরবানের সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে গরু পাচার এখন অনেকটাই নিয়মিত ঘটনা। এই চোরাচালানচক্রের অন্যতম আলোচিত নাম শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীন। যদিও তিনি বর্তমানে কারাগারে, তবুও অভিযোগ রয়েছে, সেখান থেকেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন পুরো চোরাচালান সিন্ডিকেট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, চলতি বছরের ৫ জুন রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন শাহীন। এ সময় তার কাছ থেকে ৩১টি বার্মিজ গরু, একটি ছাগল এবং আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। পরে তার আস্তানা থেকেও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি জব্দ করে বাহিনী। তদন্তে উঠে আসে, শুধু গরু নয়, সীমান্ত এলাকায় অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজি নিয়েও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
শাহীন গ্রেপ্তারের পরও থামেনি তার নেটওয়ার্ক। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দাবি, কারাগার থেকেই সীমান্তে গরু পাচারের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। মাঠপর্যায়ে এই সিন্ডিকেট চালাচ্ছে অন্তত ২২ সদস্যের একটি শক্তিশালী চক্র। এদের মধ্যে নিরুপম শর্মা নামের এক ব্যক্তি বর্তমানে সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তার অধীনে সীমান্তের চোরাপথে ফের শুরু হয়েছে গরু পাচার।
মাঠ পর্যায়ের প্রধান সমন্বয়ক ছিলো নুরুল আবছার ওরফে ডাকাত আবছার। সম্প্রতি বিজিবির অভিযানে বিপুল অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। তবে তার আগে আদালতে পাল্টা মামলা দিয়ে বিজিবির অভিযানে প্রতিবন্ধকতা তৈরিরও চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ।
জানা গেছে, শাহীন-আবছার চক্র জব্দকৃত গরুগুলো ফেরত পেতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। অথচ আদালতের নির্দেশে সেসব গরু নিলামে বিক্রি হয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এক সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কিছু নেতার ছত্রছায়ায় ছিলেন শাহীন। পরবর্তীতে বিএনপির প্রভাবশালী মহলের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সম্পর্ক। রাজনৈতিক এই ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন প্রশাসনের নজর এড়িয়ে অপরাধ করে গেছেন তিনি।
বিজিবির রামু সেক্টরের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহীনের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট এখনো গরু পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে মাসুদ ও নিরুপম শর্মার মতো দালালরা চোরাপথে গরু আনছে। চক্রের বেশিরভাগ সদস্যই একাধিক মামলার আসামি, তবুও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। চোরাচালান থেকে আয় করা টাকায় সীমান্ত এলাকায় বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা গড়ে তুলেছে এ চক্র।
গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, শাহীন কারাগার থেকেই জামিনের জন্য ঢাকায় বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছেন। একইসঙ্গে জামিন না হলে মামলা দুর্বল করতে জাল সাক্ষ্য, নথি এবং ‘মানবিক’ ইমেজ তৈরির চেষ্টা করছেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ত্রাণ বিতরণ, স্থানীয়দের সঙ্গে ছবি—যেখানে তাকে ‘দরদি’ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল হক বলেন, "সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করতে গেলে প্রথম বাধা আসে চক্রের মিথ্যা প্রচারণা ও মামলার হুমকি থেকে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়।"
বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, "শাহীন সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্যদের তালিকা আমাদের হাতে রয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।" তিনি আরও বলেন, "শাহীনের গ্রেপ্তারের পর সাময়িক চোরাচালান বন্ধ হলেও এখন নতুন নেতৃত্বে তা আবার সক্রিয়। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।"
স্থানীয়রা বলছেন, শুধু দালাল বা চালক নয়, এই সিন্ডিকেটের পেছনে থাকা রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলকে আইনের আওতায় না আনলে শাহীনদের মতো অপরাধীরা জেল থেকেও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে—আর রাষ্ট্র হারাবে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।