গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
যে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক আছে, যে শিক্ষাব্যবস্থা একটা বিশেষ অর্থনৈতিক শ্রেণিকে রিপ্রেজেন্ট করে সেটা বাই ডিফল্ট অমানবিক। কারণ এটি টিকে আছে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যের সুযোগ নিয়ে। একটা নির্দিষ্ট আপৎকালীন সময়ের জন্য এ রকম শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা বা একে চিরায়ত রূপ দেওয়াতো মানবিক হয় না। আর একে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে মহিমান্বিত করতে চাওয়া একধরনের চালাকি। আরও বড় অপরাধ। এই চালাকিটি বেশি করে সমাজের সুবিধাভোগী অংশটি, যারা নিজেরা এই সিস্টেমের ভেতর দিয়ে যান না। একইভাবে যে শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের ধনিক শ্রেণির হাতে জিম্মি, যে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সামর্থ্যরে সম্পর্ক সেটিও অমানবিক। বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে এ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা অন্যায়। শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত একুয়ালি এক্সসিবল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের সব পেশা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ যেন সমানভাবে পড়তে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শ্রেণি, পেশা ও সংস্কৃতির মানুষ যেন পড়তে পারে সেটা আমরা সবাই চাই। মাদ্রাসা থেকে আসা ছেলেটি বা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি যারা শ্রদ্ধাশীল তারাও চায়। কিন্তু মাদ্রাসায় সব সংস্কৃতির মানুষ কি পড়তে পারে? মাদ্রাসা কি ইকুয়ালি এক্সিসিবল? তার ছাত্ররা কি সমাজের সব সংস্কৃতির মানুষকে সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতে শেখে? সে হিসেবে মাদ্রাসা একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হতে পারে, কিন্তু সঠিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি হতে পারে? বাংলাদেশে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই রেসিজমের চর্চা হয়। বায়াস না হয়ে বুকে হাত দিয়ে সত্য কথা বলেন তো, এই রেসিজমের চর্চা সবচেয়ে বেশি কোথায় হয়?
মাদ্রাসা শিক্ষার যারা শিক্ষক এবং যারা অথরিটি তারা একরকম বিনা বাধায় মাইক বাজিয়ে, সভা জমিয়ে, গলা উঁচু করে প্রচার করে যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটা জেনার কারখানা। ইউনিভার্সিটিগুলো নাস্তিক মুরতাদদের আখড়া।’ এই ঘৃণার চর্চাটি হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং কোনোরকম বাধা ছাড়াই। সামাজিকভাবেও অনেক শক্তিশালী এই ঘৃণাবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা বা কারিকুলাম নিয়ে আপনারা সমালোচনা করতে পারেন। এর ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। আকছার সেটা হচ্ছেও। সেক্যুলার নাস্তিক আস্তিক সবাই করছেন। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সমালোচনা তো দূরের কথা আপনি প্রশ্নও করতে পারবেন না। যে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে, যার ছাত্রদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না সেটা কি আদৌ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকে নাকি কাল্ট সিস্টেমে পরিণত হয়? দুটো আলাদা শিক্ষাব্যবস্থায় এরকম হাজারো বৈষম্য টিকিয়ে রেখেও আপনি যখন ইকুয়ালি এক্সসিবল করতে চাইছেন সেটা কি ঠিক হচ্ছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেসবাহ কামাল মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের ভর্তি পরীক্ষার স্কোরিং সিস্টেমের বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু যারা তাঁর সমালোচনা করছেন তারা এই প্রসঙ্গটি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।
মাদ্রাসা ছাত্ররা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করছে এটা অবশ্যই ভালো। তার চেয়েও ভালো হয় যদি তারা সামগ্রিকভাবেই লেখাপড়ায় ভালো হয়। মাদ্রাসার ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করছে, এটা আইসবার্গের ওপরের অংশ। এটি দেখিয়ে যারা বিশেষ যুদ্ধে জয়ী বলে ভাবছেন তারা কোনোদিন ভেবে দেখেন না মাদ্রাসার টাইটেল পাস করা কতোজন ছাত্র শিক্ষার ন্যূনতম মূল্যায়ন পান, মেইন স্ট্রিমের জব পান। আমি টাইটেল পাস ছেলেকে বাসার কেয়ারটেকার (আসলে দারওয়ান) হতেও দেখেছি। সেই বাড়ির মালিকের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসার ছাত্র থাকে না। এসব প্রশ্নে তখন অবশ্য তাদের উত্তর হয় ভিন্ন লাইনে। যেমন এখানে ইহজাগতিক প্রাপ্তির আশায় কেউ পড়ে না। সেটা হলেও কথা ছিলো না। দেখা যায় তারা ইহজাগতিক সিস্টেমেও যেতে চান আবার ইহজাগতিক চ্যালেঞ্জকে রেসিজম বলে ট্যাগ মারতে চান। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সার্বজনীন করলে বোধ করি কারোরই আপত্তি থাকবে না। এদেশের একেকজন প্র্যাক্টিসিং ধার্মিক মুসলমান ছেলেমেয়েরও স্বপ্ন থাকে তারা হলিক্রস বা সেন্ট জোসেফে পড়ালেখা করবে। সেখানে গির্জায় ঘণ্টা বাজে, ফাদার সাদা জোব্বা পরেন, প্রভু যীশুর নাম নেন কথায় কথায়। কিন্তু কারও কোনো আপত্তি থাকে না। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন আপনার মাদ্রাসা নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন হিন্দুর ছেলে স্বস্তি নিয়ে লেখাপড়া করতে পারবে? আপনি নিজেই ইনক্লুসিভ নন। কিন্তু আপনি চান আপনার জন্য সবাই ইনক্লুসিভ হয়ে উঠুক। আপনার জন্য সবাই রেসিজমহীন, সাম্যবাদী, সেক্যুলার হয়ে উঠুক। আপনি খেলাফত চান, তালেবান চান। কিন্তু আপনি চান আপনার সঙ্গে সবাই ব্রিটিশ/আমেরিকান গণতান্ত্রিক আচরণ করুক।
লেখক : চিকিৎসক