জান্নাতুল নাঈম পিয়াল: ছোটবেলা থেকে আমরা যতোই শুনে থাকি না কেন যে পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি, এটাই আমাদের সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছে দেবে, তা আসলে সত্য নয়। এমনই বিশ্বাস জেফ শ্যাননের। তিনি একজন নির্বাহী প্রশিক্ষক এবং ‘হার্ড ওয়ার্ক ইজ নট এনাফ: দ্য সারপ্রাইজিং ট্রুথ এবাউট বিয়িং বিলিভেবল অ্যাট ওয়ার্ক’ বইয়ের লেখক।
শ্যাননের মতে, কঠোর পরিশ্রম সূচনা হিসেবে বেশ ভালো। ক্যারিয়ারের গোড়ার দিকে এটি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করতে পারে আপনার নতুন চাকরিতে বা কর্মস্থলে থিতু হতে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু, কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়, যদি আপনি চান সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে একদম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে। অর্থাৎ, একজন নিছকই সাধারণ কর্মী থেকে নেতৃস্থানীয় পদে উত্তীর্ণ হতে। এর কারণ কী? শ্যাননের মতে, ‘একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে আপনি আপনার চারপাশে তাকাবেন এবং বুঝতে পারবেন, বাহ! এই পর্যায়ে সকলেই তো কঠোর পরিশ্রম করে। নিজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও কঠোর পরিশ্রম এখানে পরিণত হয় প্রাথমিক প্রত্যাশায়, ফলে তা আর আপনাকে সিঁড়ির ওপরের ধাপগুলোতে পরিচালিত করবে না।’ এই কথাগুলোর নেতিবাচক অর্থ না করেও বাস্তবতাকে আমরা এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি: আমরা সবাই এমন একটি সিস্টেমের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, যেটি শুধু এবং কেবলই শুধু কঠোর পরিশ্রমকে মূল্যায়ন করে না। কর্মজীবনে সামনের দিকে এগোতে গেলে কঠোর পরিশ্রমের চেয়েও আপনার মধ্যে আরো কিছু গুণাবলি সন্নিহিত থাকতে হবে, আরো কিছু কাজ আপনাকে করতে বা পারতে হবে। আর তা না হলে, আপনি যতোই প্রতিভাধর হন না কেন, কর্মজীবনের কোনো একটা সময়ে আপনার মনের মধ্যেও লিস্টারের লেখা চিন্তাগুলোরই অনুরণন ঘটবে। বিশেষত যখন দেখবেন, আপনার সমান (বা কম) যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়েও আপনার এক বা একাধিক সহকর্মী ক্যারিয়ারে উড়ে বেড়াচ্ছে, একের পর এক সাফল্যের দেখা পাচ্ছে, অথচ আপনি এতোদিন যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছেন। শ্যানন বলছেন, কঠোর পরিশ্রম কোনো কাজেই লাগে না, যদি না অন্যরা আপনার কাজের স্বীকৃতি দেয়। কেননা সেই স্বীকৃতিরই প্রতিফলন ঘটে কাজে প্রমোশন কিংবা বেতন ও সম্মান বৃদ্ধির মাধ্যমে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনসাল্টিং ফার্ম নেগোশিয়েটিং উইমেন ইঙ্কের প্রেসিডেন্ট ক্যারল ফ্রলিংগার বলেন, কঠোর পরিশ্রম এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অন্য কেউ নিজে থেকে আপনার কঠোর পরিশ্রমের ব্যাপারটি বুঝে যাবে, সেজন্য অপেক্ষা করা ক্ষতিকর। তার মতে এ ধরনের প্রবণতা হলো ‘টিয়ারা ইফেক্ট’। ‘কিছু মানুষ আছে যারা সত্যিই প্রচুর খাটে এবং সেই সুবাদে নিজেদের কাজে দারুণ ফল বের করে আনে। কিন্তু তারপর তারা আশা করতে থাকে যে সঠিক মানুষেরা তাদের এই কৃতিত্বের বিষয়টিকে লক্ষ্য করবে এবং তাদের মাথায় টিয়ারা (মুকুট) পরিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা সাধারণত হয় না। ‘যেসব কর্মী খুবই ভালো কাজ করে, কিন্তু অন্য কিছু করে না, তারা সাধারণত পাদপ্রদীপের আলোয় থাকে না। কেউ তাদের দিকে আলাদা করে নজর দেয় না, তাদের কথা ভেবে দেখে না। তাই যখন কোনো প্রমোশনের সুযোগ আসে, তখনো তাদের কথা বেমালুম ভুলে যায় সবাই।’ এই সমস্যার শেকড় প্রোথিত রয়েছে সেই প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ের শিক্ষায়, যেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের বলা হয় সবসময় চুপ থাকতে, কেননা যারা পরিশ্রম করে তারা এমনিতেই সফল হয়। বাস্তবিকই জীবনের সেই প্রথম কয়েক বছর শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের পরিশ্রম ও নীরবতার গুণকে পুরস্কৃত করে, যে কারণে তাদের অবচেতন মনে এ ব্যাপারটি থেকে যায় যে তাদের ভবিষ্যতের বসদের কাছ থেকেও তারা একই ধরনের প্রতিদান পাবে। কিন্তু যখন সেই আশা সত্যি হয় না, তখন নেমে আসে কর্মজীবনের প্রতি হতাশা, বিরক্তি, ও অনাসক্তি। শ্যানন তাই এই ব্যাপারটির ওপর বারবার গুরুত্ব দেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর শুধু কঠোর পরিশ্রম আর কাজে লাগে না। কারণ সেই নির্দিষ্ট পর্যায়ে সকল কর্মীরই থাকে প্রায় সমান দক্ষতা ও যোগ্যতা। তাই কেউ যদি আলাদা করে সবার মনোযোগ ও আকর্ষণ নিজের দিকে না টানে, তাহলে তার আড়ালে চলে যাওয়ার আশঙ্কাই থাকে অনেক বেশি। সাধারণত নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গের কর্মীরাই কমবেশি এ ধরনের আড়ালে চলে যাওয়া তথা নিজেদের কাজের যথাযথ স্বীকৃতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তবে ফ্রলিংগারের মতে, নারীদের জন্য এ ব্যাপারটি সামলানো বেশি দুষ্কর হয়ে পড়ে। পুরুষরা সহজেই নিজেদের কাজের ব্যাপারে বাগাড়ম্বর করে সকলকে সেগুলো জানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নারীরা নিজেদের কৃতিত্বের ব্যাপারে উচ্চকিত হবে, তা এই সমাজে এখনো গ্রহণযোগ্য নয়। ‘নারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণকে দেখা হয় হামবড়াই ভাব হিসেবে এবং যে নারীরা বড়াই করে, তাদের শাস্তি পেতে হয়।’
এখন এ ধরনের স্টেরিওটাইপ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তর হলো: আপনি নারী বা পুরুষ যাই হোন না কেন, আপনাকে চুপচাপ বসে অন্য কারো আপনার কাজের মূল্যায়নের অপেক্ষা করা যাবে না। এর বদলে এমন কোনো একটা উপায় বের করতে হবে যাতে করে অন্যরা পরিষ্কারভাবেই দেখতে, জানতে ও বুঝতে পারে আপনার কঠোর পরিশ্রম ও কাজের ইতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে। এক্ষেত্রে ফ্রলিংগারের পরামর্শ হলো, বসকে আপনার কাজের ব্যাপারে নিয়মিত, তবে সংক্ষিপ্ত, আপডেট জানাতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে আপনার সাফল্যের কথাকে প্রাসঙ্গিকভাবে কোনো আলাপচারিতায় নিয়ে আসার। ‘এটি হতে পারে কেবলই বুলেট পয়েন্ট সমৃদ্ধ একটি ছোট মেইল, যেখানে আপনি বলবেন, ‘এগুলো হলো আমাদের কাজ, এগুলো হলো আমাদের সাফল্য, কোম্পানি এইসব উপায়ে উপকৃত হয়েছে, এভাবে কোম্পানির সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে।’ তবে মনে রাখবেন, রোজ রোজ কারো কৃতিত্বের কথা কিন্তু কেউই শুনতে চায় না। তাই এ ব্যাপারে আপনাকে পরিমিতিবোধ দেখাতে হবে। এছাড়া শুধু ‘আমি আমি’ না করে ‘আমার দল ও আমি’ জাতীয় বাক্যাংশ ব্যবহার করবেন, যাতে অন্যরা বুঝতে পারে আপনি অন্যদেরও তাদের কাজের কৃতিত্ব দিতে কার্পণ্য করছেন না।’ ঈষৎ সংক্ষেপিত। সূত্র : রোর বাংলা।