ফিরোজ আহমেদ: শেখ আবদুল হাকিম মারা গেলেন, সাথে নিয়ে গেলেন এক টুকরো শৈশব।১৯৮০ দশকে যারা বালক এবং কিশোর, মাসুদ রানা তাদের জন্য ছিল একটা নতুন দুনিয়া। অভিভাবক ও শিক্ষককূলের জাতীয় শত্রু ছিল এই নামটি। কিন্তু সেটা যে শেখ আবদুল হাকিম লিখতেন তা জানতাম না অবশ্যই। তবু তার অনুবাদ করা অন্য কয়েকটি বই তোলপাড় তুলেছিল। প্রাচীন মিশরের রাজপরিবারের প্রেক্ষাপটে রচিত আগাথা ক্রিস্টির একটা রহস্য উপন্যাসকে তিনি ‘কামিনী’ নামে অনুবাদ করেছিলেন। সেটারও বিষয়বস্তু বড়দের হলেও আমাদের হাতে আসতে বিলম্ব হয়নি।
নামকরণে যৌনাত্মক ইঙ্গিত পরিষ্কার থাকলেও এতো বছর পর স্মৃতির তলানিতে এটুকু কেবল জমে আছে যে, মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে বিপুল আগ্রহ তৈরি করেছিল বইটা, এরপর থেকে মিশর বিষয়ে যা কিছু পেতাম খুঁজে পরে ফেলতাম। কিছু পরে আসতে থাকা তার ও অন্যদের লেখা 'সেবা রোমান্টিক' ভালো লাগেনি, সম্ভবত সেবা প্রকাশনীর সাথে রুচির দূরত্ব অনুভব করতে থাকি তখন থেকেই। কিংবা এমনটাও হতে পারে সেগুলোর জন্য বয়সের দিক দিয়ে আমরা উপযুক্ত ছিলাম না। ইমদাদুল হক মিলনের প্রেমর উপান্যাসও বিরক্তিকর ঠেকতো। তবে সেটা পুরোপুরি নাও হতে পারে, হয়তো মানের সমস্যাই ছিল। কেননা ওই সময়েই হুমায়ূন আহমেদের বিষয়ে নেশাটা জন্মাতে থাকে, অন্য উপন্যাস টানতো কম, সুনীল-শীর্ষেন্দু-সাবের-তারাশঙ্কর, এমনকি রুশ উপন্যাসের অনুবাদগুলোও তো বিস্তর পড়েছি ঘোরের মত। সেবা রোমান্টিক পছন্দ না হলেও সেবার অনুবাদ উপন্যাসগুলোতে যাদের নাম দেখা মাত্র পড়তাম কিংবা ভাড়ায় আনতাম (কিনতাম না প্রায়), তাদের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম, সাথে বলা যায় রওশন জামিল, জি এইচ হাবীব, নিয়াজ মোর্শেদ এদের কথা, আরও কয়েকজন ছিল, ভাবলেই তাদের নাম মনে আসবে।
লিখে খেতে চেয়েছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। এই কঠিন কাজটা অল্প কিছু সৌভাগ্যবান বাদ দিলে বাংলাদেশে সর্বদা সম্মানের না, সম্ভবও না। মনে হয় এখন আরও কঠিনই হয়েছে। বাজার বেড়েছে সামান্য, কিন্তু বইয়ের সংখ্যা আর বিকল্প বিনোদনের মাধ্যম বেড়েছে বহুগুন। ৮০র দশকের অজস্র খারাপ অনুবাদ কিংবা ভুল অনুবাদ এখন চোখে পরে, সেটা সত্যি, যাচাই করার সাধ্য সেই বয়েসে ছিল না। কিন্তু মনে হয় গড় অনুবাদের মান তখনকার দিনে একটু ভালো ছিল। চিরবিষণ্ণরা হয়তো বলবেন তখন লোকে গড়ে বাংলাটা অন্তত জানতো, এখন দুইটা ভাষাই ভুলে গেছে।
মাসুদ রানার স্বত্ত্ব নিয়ে মামলাতে যে মৌলিক প্রশ্নগুলো উঠেছিল, তার একটা ছিল অনুবাদ স্বত্ত্ব। একটা রহস্য উপন্যাস তৈরি করতে গেলে যে বিনিয়োগ লাগে, সামাজিক প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা লাগে, তা চাইলেই বাংলাদেশে বসে করা সম্ভব না। অন্যদিকে অনুবাদ স্বত্ত্ব পেতে গেলে যে পুঁজি লাগে, সেটা না থাকলে তো ‘বৈধভাবে’ মাতৃভাষায় পাঠকদের রোমাঞ্চ উপন্যাসের স্বাদ দেয়াটা সম্ভব না। ‘বৈধতা’র খপ্পরে পরে পাঠকদের বঞ্চিত করা হবে, নাকি বৈধতাকে মর্যাদা দিয়ে সেই রসশূন্য মরুভূমিতে পাঠকদের ফনিমনসাতেই তৃপ্ত রাখাÑ এই দুই বিষম বৈপরিত্য তখন আলোচিত প্রশ্ন ছিল।
কিন্তু আসল প্রশ্নটা আরও গভীর, জটিল ছিল: লেখকরা কী লিখে খেতে পারবেন? সেটা না করাটা পর্যন্ত সম্ভাবনাময় লেখকদের বড় অংশের তো নানান রকম ক্ষমতাবানের অনুগ্রহভাজন কিংবা সরকারের মোসাহেব হবার প্রক্রিয়াটা সমাজে জারি থাকবে। অথবা, লেখাটাকে তারা আংশিক কাজ হিসেবে নিয়ে আরও নানান কিছু করে পেট ভরাবেন। খুব মর্মান্তিক একটা প্রশ্ন। লিখে বাঁচতে চাওয়া শেখ আবদুল হাকিমের চলে যাবার দিনে শৈশবের স্মৃতিগুলোর পাশাপাশি বর্তমান নিয়ে এই কথাটাই বারবার মাথায় আসছে। লেখক ও রাজনীতিবিদ। ফেসবুক থেকে