মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : [শিরোনামের দুজনই আমার পরিচিত ও প্রিয় ব্যক্তি। সমকালীন ইতিহাস বিষয়ে গবেষক ও জনপ্রিয় গ্রন্থকার মহিউদ্দিন আহমদ আফগানিস্তানে তালেবান পুনরুত্থান নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পরে আমার সাবেক সহকর্মী কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর তাঁর পোস্টটিকে এ বিষয়ে সেরা লেখা অভিহিত করে শেয়ার করেন। ভূয়সী প্রশংসায় তিনি বলেন, এর পর ফেসবুকে আফগানিস্তান নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আর কারও লেখা পড়ার তিনি প্রয়োজন বোধ করছেন না। এই পটভূমিতে আমার নিচের লেখা।
মহিউদ্দিন ভাইয়ের লেখাটা আমি পড়েছি। কোনো মন্তব্য করিনি। এখন সাগরের উচ্ছ্বাস দেখে ভাবলাম একেবারে চুপ না থাকি। আমি সাগরের মতো উৎসাহিত হতে পারিনি। আফগানরা বিদেশিদের কখনো মেনে নেয়নি বলে তাদের প্রতি সালাম। তবে তালেবানি শাসন আফগানদের জাতিগতভাবে স্বকীয় ও জনসমর্থনধন্য তা বলি কীভাবে? তাদের প্রচুর সমর্থক থাকতে পারে, কিন্তু তারা জন্মগতভাবে একটি সশস্ত্র গ্রুপ, যা ১৯৯৪ সালে গঠনে পাকিস্তানি মিলিটারির ভূমিকা ছিলো। প্রধানত পশতুন উপজাতীয়দের নিয়ে গঠিত। আর সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তাদরে ব্যবহার করতে আমেরিকার ভূমিকা ছিলো। তাদের যে কট্টর শরিয়া আইনে দেশ শাসনের রাজনৈতিক মতাদর্শ তাতে জনসমর্থনের ধার ধারবে না কখনোই। তারা কখনোই গণতন্ত্র অনুযায়ী জনগণের ম্যান্ডেট চাইবে না। ১৯৯৬-২০০১ সালে দেশ শাসন ও তাণ্ডব জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে করেনি। কাজেই এখন ‘তাদের পেছনে আফগান জনগণের সমর্থন আছে’ কীভাবে বলা যায়? তারা ক্ষমতায় থাকলেও এখন ও ভবিষ্যতে কখনোই প্রমাণ করা যাবে না যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান নাগরিকরা তাদের সমর্থন করে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লব রপ্তানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উড়ে এসে জুড়ে বসার মাতব্বরি দুটোই প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কিন্তু তালেবান কবলে যদি দেশটি সংকটে (মানবাধিকার পদদলিত হওয়াসহ) পড়ে তবে বিদেশি হিসেবে আমরা ও বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন হবো না? কোনো দায়িত্ব থাকবে না? ‘আফগানিস্তান আফগানদের হাতে ছেড়ে দেন ‘কি’ তালেবানদের হাতে ছেড়ে দেন’ বলা হলো না? ট্রাম্প ও বাইডেন তাহলে ঠিক কাজটি করেছেন আর আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে ভুল করছি? সারা দুনিয়াতেই তো উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীদের নিরাপত্তা ও আলকায়েদা-আইএসের ঘাটি হয়ে ওঠে কি-না সে প্রশ্নে।
কোনো জাতি এ-রকম বিপদে পড়লে ইতিহাসে তাদের উদ্ধারের চেষ্টায় আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের মহান দৃষ্টান্ত আছে। ১৯৩০ সালের দুনিয়া এখন নয়। এখন জাতিসংঘের কাঠামোয় আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতেও পারে; চীন-রাশিয়ার সম্ভাব্য বিরোধিতায় তা বাস্তবে সম্ভব কি-না সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। ‘ঢাকায় বসে যারা তালেবানফোবিয়ায় ভুগছেন এবং ফেসবুক সয়লাব করে দিচ্ছেন তারা নিজ দেশে তালেবানদের উত্থান ঠেকাতে পারেননি’Ñ মানে প্রথমত, এটা ‘ফোবিয়া’ তথা অযৌক্তিক ভীতি এবং দ্বিতীয়ত, এদেশে তালেবানদের উত্থান ঘটেছে এবং তা ঠেকানো যায়নি? (!) মহিউদ্দিন ও সাগর দু'জনেই জানেন ভোলা রামু ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি কাণ্ডগুলো যারা ঘটিয়েছে তারা ’৯০ দশকে গোপনে আফগানিস্তান ও পেশোয়ারে যেয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা নিয়ে এসে হুজি-বি, জেএমবি এখানে গড়েছিলো। তাদের ঠেকানোর জোর চেষ্টা তো চলছেই। মুফতি হান্নান, বাংলাভাই, শায়খ রহমানদের ফাঁসি, হলি আর্টিজান ম্যাসাকারের পরে অসংখ্য সফল অভিযানে যদি ঠেকানো না হতো তাহলে আমরা অনেকেই বাঁচতাম কি-না জানি না, মহিউদ্দিন ভাইকেও হয়তো সাগরের কাছে চলে যেতে হতো। তাই আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানে বাংলাদেশে জঙ্গিদের উৎসাহিত হওয়াকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা ফোবিয়া নয়, সঙ্গত উদ্বেগ।
ওই দেশে তালেবানের জন্মের অনেক যুগ আগে থেকে এ-দেশে তিন তালাক, হিল্লা বিয়ে, ফতোয়াবাজি ও বাল্যবিবাহ চলছে। এর সঙ্গে তালেবানের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো ধর্মের সংকীর্ণ ও বিতর্কিত ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভূত সামাজিক সমস্যা যা পশ্চাদপদ কৃষক ও মোল্লারা বহন করছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে করা মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশে (১৯৬১) বহুবিবাহ, তালাক, এমনকি সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ কিছু সংস্কার করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু আইন ও নারী আন্দোলনের ফলে ক্রমে ওই প্রাচীন সামাজিক কুসংস্কারগুলো কমে আসছে, যেগুলো নতুন করে তালেবান ও আইএস জঙ্গিরা আনেনি। তালেবানরা তাদের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রে শরিয়া আইনের নামে এগুলো অস্ত্রের জোরে চাপিয়ে দিতে চায়। আমাদের নারীদের গৃহকর্মের চাকরি নিয়ে আরবে যাওয়ার বিরোধিতা করতেই পারি, কিন্তু সেটাও কি তালেবানি ব্যাপার? এ-রকম ধারণাগত ভুলের মতো মহিউদ্দিন ভাই আফগান ইতিহাস বিষয়ে তথ্যগত ভুলও করেছেন। যেমন, বাদশাহ জহির শাহ্কে খেদানোর কৃতিত্ব তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়েছেন। এখন আমেরিকার পরিপোষিত হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনির সরকারকে ‘রাজাকার’ অভিহিত করার সমান্তরালে তালেবানকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ মনে করলে সেটাকে অতি সরলীকরণ না গরলীকরণ বলবো বুঝতে পারছি না। তবে ‘আগে নিজের ঘর ঠিক’ না করে অন্য দেশের বিষয় নিয়ে ‘ফেসবুক সয়লাব’ করাকে তিরস্কারের মধ্যে একটা বেশ জাতীয়তাবাদী ভাব আসে। সেটা সংকীর্ণ, সরলরৈখিক ও অগভীর। মহিউদ্দিন ভাই ও সাগরকে সবিনয়ে পুনর্ভাবনার আহ্বান জানাই। ফেসবুক থেকে