হেলাল মহিউদ্দিন: [১] নারী ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছিলো পূর্ব মিয়ানমারের লইকো জেলার স্যাক্রেড হার্ট চার্চে। ভেবেছিলো সেনা-পুলিশ অন্তত চার্চে ঢুকবে না। ঢুকলেও রক্তারক্তি করবে না। নারী ও শিশু দেখে ফিরে যাবে। তাছাড়া বুদ্ধের জন্মদিনের আগের দিন। বুদ্ধ শিখিয়েছেন ‘জীবহত্যা মহাপাপ’! কিন্তু সেনা-পুলিশ ঢুকেই চারজনকে হত্যা করলো। আটজন আশঙ্কাজনকভাবে গুলিবিদ্ধ। আরও সিভিলিয়ান আহত। অথচ সেনাশাসকরাও বুদ্ধপ্রেমি, ধার্মিক। তাই মিয়ানমারে ৬০০টি শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক সুরম্য আশ্রম-মঠ বানিয়ে দিয়েছে। দামি মর্মরে বুদ্ধর বাণী খোদাই করে দিয়েছে। সেগুলোতেও লেখা- ‘জীবে দয়া করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। সেই সেনাশাসকরাই জীবে ‘দয়া’র ছিটেফোঁটা দেখানো দূরে থাক, ...নির্দয়ভাবে জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া বিষয়ে দয়া দেখানোর কিছু নেই। স্বদেশেই ফেব্রুয়ারির ৩ হতে মে মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত হত্যা করেছে স্বধর্মেও ৮২৭ জনকে। ৪৩২৩ জন এখনো ডিটেনশনে। ১৪ জনের মৃত্যু পরোয়ানা হয়েছে। ওয়ারেন্টের আসামিসহ আহত ও পলাতক অগণিত। (তথ্য ‘এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স’ এর)। ভিক্ষুনেতা অশ্বিন ভিরাথু। তাকে টাইম ম্যাগাজিন খেতাব দিয়েছে ‘এশিয়ার বিন লাদেন’। বুদ্ধের বাণী থাকবে যার সত্ত্বায় ও কর্মে, তার নেতৃত্বেই কয়েক হাজার ভিক্ষু ও ধর্মাচারী জনতা সেনা-পুলিশের সংযোগে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে কমপক্ষে দশ হাজার রোহিঙ্গাকে। আহত করেছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষকে। পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে সাড়ে চারশ গ্রাম। মাতৃভূমি হতে বিতাড়িত করেছে ১২ লাখ মানুষকে! হতমানে অপমানে বুদ্ধের বাণী কি নীরবে নিভৃতে কাঁদে না? কাঁদে!
[২] এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ কি মহামতি বুদ্ধ? দায় কি তার? উত্তর ‘এক কণাও না’। তাহলে কি ‘বৌদ্ধধর্ম’? মোটেই না। পৃথিবীতে একটি ধর্মও নেই যেটি মানুষকে অমানুষ হতে বলেছে! ধর্মের পলিটিক্যাল ইকোনোমিক ব্যবহারের মূল খেলোয়াড় রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষ মহল। পৃথিবীর সকল দেশেই। এর একটি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ প্রকল্প। ধর্মভিত্তিক ঘৃণা উস্কে দিয়ে জনতাকে বিভাজিত করে রাখা একটি সুপরিকল্পিত প্রকল্প। মিয়ানমার এই কৌশলেই রোহিঙ্গা নিধনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো। ফেসবুকে একদল মুসলিমবিরোধীকে প্রমোট করেছিলো যারা পলিটিক্যাল ইকোনমির ‘পি’ও ঠিকঠাকমত জানে না। মূলত পাঁড় মূর্খ ও অর্বাচীন, কিন্তু নিজেদের প্রগতিশীল ও জ্ঞানগম্যিদার দেখানোর ফ্যাশনে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও সম্প্রতি এই ঘরাণার বেশ প্রজনন দেখা যাচ্ছে। তারা অন্তত প্রশ্ন করতে শিখুক একদিকে ৬০০ প্যাগোডা বানানো, ভিক্ষুদের পারিতোষিক ও সুযোগসুবিধা বাড়ানো, অন্যদিকে তাদের রোহিঙ্গা-নিধনে লাগিয়ে সেনাশাসকেরা বুদ্ধবাণীকেও অনায়াসে পদদলিত করেছিলো কেন? উত্তরটি স্লাভোয় জিজেককে উদ্ধৃত করে দিতে হয় ‘Its all about the political economy, stupid!’ (২০১৩), অথবা ১৯৯২ সালে প্রথমবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেনেওয়ালা জেমস কার্ভিলের মতো বলতে হয় ‘Its the economy, stupid!’ [প্রসঙ্গক্রমে It‘s the Political Economy, Stupid! শিরোনামের একটি সংকলিত বইতে (প্রচ্ছদ প্রথম কমেন্টে) স্লাভোয় জিজেক, ডেভিড গ্র্যায়েবার, জুডিথ বাটলার, ব্রায়ান হোমস প্রমূখের চিন্তা-জাগানিয়া কয়েকটি সুপাঠ্য লেখা আছে। এটি এখন এক ধরণের ডিস্কোর্স-এর রূপ পেয়েছে।]
পলিটিক্যাল ইকোনমি কীভাবে? উত্তর- মিয়ানমারের আছে কয়েকশ’ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠার জিব-লকলকে লোভ। সেই তুলনায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মুসলিমবিদ্বেষী ও মৌলবাদী হয়ে ওঠা নিতান্তই নস্যি বিষয়। রাখাইনে চীনা অর্থায়নে এশিয়ার সবচাইতে বড় স্পেশ্যাল ইকোনোমিক জোন (এসইজেড) গড়া, অদূরে বঙ্গোপসাগর ডীপ সী পোর্ট নির্মাণ, রাখাইন পর্যন্ত তেল-গ্যাস- রেললাইন ও পরিবহন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভকে ফলদায়ক করা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থেকেও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা সমরশক্তি হবার উদগ্র কামনা, আর গণহত্যার দায়ে জাতিসংঘে অভিযুক্ত হওয়া এড়াতে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতেই হবে। সে জন্য অন্য সকল টোটালিটারিয়ান একনায়ক ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করে, মিয়ানমারের সেনাশাসকরাও করছে। ২০০৭-২০০৮ সালেও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিলো সেনাবিরোধী। তাদের তীব্রতম আন্দোলনটি ‘গেরুয়া বিপ্লব’ নাম পেলো। অসংখ্য ভিক্ষু প্রাণও দিলো। সেই প্রতিবাদী ভিক্ষুরাই মাত্র কয়েক বছরের মাথায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে সেনাশাসকদের সহযোগি হয়ে ওঠলো। অথচ তারা সকলেই বৌদ্ধের অনুসারি। ধর্মে কতোটা কী রকম মশলা লাগলো না লাগলো, তাতে খুব সামান্যই আসে যায়। যেটা আসে যায় সেটি কার্ভিল অসংখ্যবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ‘Its the economy, stupid!’ ফেসবুক থেকে