ড. শোয়েব সাঈদ: ‘বি.১.৬১৭’কে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বলাতে ভারত প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারতের এই আপত্তির পেছনে জাতিগত বিদ্বেষের আশঙ্কাসহ কিছু যৌক্তিক প্রেক্ষিত রয়েছে বটে, তবে প্রচলিত এই ডাকনাম ব্যবহারে ভারতেরও বেশি স্পর্শকাতর হওয়া উচিত নয়। কোভিড চিকিৎসায় গরুর মল-মুত্র ব্যবহারের যে ন্যাক্কারজনক সর্বভারতীয় চিত্র বিশ্ব মিডিয়া বিদ্রুপাত্মকভাবে উঠে এসেছে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে ভারতীয়দের বৈশ্বিক সন্মানে আঘাত লেগেছে তাতে। এই অবস্থায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রাযুক্তিক শব্দ চয়নে স্পর্শকাতরতা দিনশেষে যুক্তি হারায়। ইউকে, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ব্রাজিল কিন্তু এতোটা স্পর্শকাতরতা দেখায় নি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সার্স-সিওভি-২ কে উহান ভাইরাস, চীনা ভাইরাস, কুংফু ভাইরাস ইত্যাদি শব্দচয়নের সাথে বিশ্ববাসী পরিচিত। তারপর ইউকে, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল হয়ে এখন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নামকরণে ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় নেওয়াটা সহজবোধ্য প্রথা বা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভ্যাসটির একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে এর ফলে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে ঐ দেশের লোকজনের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষের সুযোগ তৈরি হয় যার ফলশ্রুতিতে অপমানিত হওয়া থেকে শুরু করে হামলার মুখে পড়তে হয়। কোভিডকালে পশ্চিমা বিশ্বে চীনাদের প্রতি অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে রোগের নামকরণ নিয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। তাতে ভৌগলিক অবস্থান, মানুষের নাম, কোন প্রাণী, খাদ্য সহ এমন নামকরণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে যা বিদ্বেষ, ভীতি ইত্যাদি সৃষ্টি করে। অফিসিয়ালি অবশ্য সেটি কখনো করাও হয়না।
কিন্তু বাস্তবে নামকরণের কোন সহজ পথের নির্দেশনার অনুপস্থিতিতে অক্ষর, সংখ্যা আর ডটের জটিলতায় বিশেষ করে কোভিডকালের একের পর এক ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাবে বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর গবেষণার বাইরের দুনিয়ার মানুষজন দেশের নামে ভ্যারিয়েন্ট চেনার সহজ পথটুকুতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন হয়তো, অনেকটা ডাকনামের মত। শুধু দেশ নয় অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ও হয়েছে। ইউকে ভ্যারিয়েন্টকে কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট, বি.১.৫২৬ কে আমেরিকানের বদলে নিউ ইয়র্ক ভ্যারিয়েন্ট বলা হয়েছে।
সার্স-সিওভি-২ অর্থাৎ এই কোভিড ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে বি ডট ১ দিয়ে শুরুটি গত বছর ইতালিতে প্রাদুর্ভাবের সাথে সম্পর্কিত। তারপর থেকে বিজ্ঞানীরা এই বি ডট ১ ভ্যারিয়েন্টের অনেকগুলো সংস্করণের উৎপত্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ বা চিন্তার কারণ সেগুলোই কেবল সাধারণ মানুষজন জানতে পারছেন। ইতিমধ্যে অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্টের দেখা মিলেছে যেগুলো বিজ্ঞানীদের, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহের (ইন্টারেস্ট) কারণ। তারমধ্যে এখন পর্যন্ত চারটি উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ইউকে তে প্রাপ্ত বি.১.১.৭, দক্ষিণ আফ্রিকার বি.১.৩৫১, ব্রাজিলের পি ১ (বি.১.১.২৮.১) আর সম্প্রতি ভারতে প্রাপ্ত বি.১.৬১৭ হচ্ছে ভিওসি অর্থাৎ ভ্যারিয়েন্ট অব কন্সারন। এই ৪টি ভিওসি মর্যাদার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অধিক সংক্রমণ সক্ষমতা আর ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দেবার কয়েকটি ভীতিকর মিউটেশন উদ্বেগের মূল কারণ।
আমাদের ভাগ্য ভালো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিপদজনকটি অর্থাৎ ভ্যারিয়েন্ট অব হাই কন্সিকুয়েন্সেসের কোন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটেনি। তবে যত সংক্রমণ তত মিউটেশন আর ভ্যারিয়েন্ট উদ্ভবের সম্ভাবনা তত বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্ট বি.১.৩১৫ এর সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায়ে বিস্তার লাভ করা ভ্যারিয়েন্ট বি.১.৩৫১ এর সংখ্যাগত সাদৃশ্য বিজ্ঞানীদেরকেও বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল। এরকম একটি জটিল অবস্থায় প্রথমদিকে সবচেয়ে বেশী ছড়িয়ে যাওয়া দেশের নামে ভ্যারিয়েন্টকে চিনার সহজ পথটাই বেছে নিতে মানুষ উৎসাহিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট আর স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কাছ থেকে বায়ো ইনফরমেটিক্স গবেষকদের কাছে অনুরোধ ছিল দেশের নাম ব্যবহার না করার। আনুষ্ঠানিক নামকরণ হচ্ছে অফিসিয়াল বিষয়, পাবলিকেশন সহ সরকারি নথিপত্রে সেভাবেই থাকবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গভীরতায় না গিয়ে সহজভাবে চেনার বিষয়টি জনগণ গ্রহণ করলে এ থেকে উত্তরণটা আর হয়ে উঠে না। অনানুষ্ঠানিক কথনে দেশের নামটি জড়িয়ে গেলে খুব বেশী কিছু কি করার থাকে? তবে তা যেন মানুষকে অপমান করার অমানবিকতার হাতিয়ার না হয়। লেখক : গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ