সাদিয়া নাসরিন: আম্মা। আয়েশা সুলতানা। জান্নাত আর জাহান্নামের মাঝখানে হাঁটতে থাকা এক ক্লান্ত সওয়ারী। নিজের আভিজাত্য আর অহমের বোধে আক্রান্ত নিঃসঙ্গ পথিক। কে বলে, অনার কিলিং শুধু অন্যের হাতে হয়? মানসম্মান, ব্যক্তিত্ব আর রুচিবোধের চাপে যে কতো আয়েশা সুলতানা নিজের কাছে নিজে খুন হয়ে পড়ে থাকে, তার হালখাতা লেখা হয় শেষ বেলায় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। আম্মা ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই-বোনের কাছে মানুষ হয়েছে। যে ভাইয়ের কাছে আম্মা বড় হয়েছে সে বাড়িতে শিক্ষা, রুচি আর আভিজাত্য ছিলো দেয়ালে দেয়ালে। সেই রুচি আর আভিজাত্য আম্মা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো আমাদের গেরস্থ পরিবারের বউ হয়ে আসার সময়। কিন্তু আমাদের নোনচা ধরা ঝাড় জঙ্গলের বিশাল যৌথ পরিবার আম্মার রুচি আর আভিজাত্যকে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই আম্মাকে বিসর্জন দিতে হয়েছিলো অনেকটুকুই। তার বদলে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিলো নয়জন দেবর ননদের বিশাল পরিবার ও জমি জমা আর মামলা মোকদ্দমার দায়িত্ব। ডাঙায় ছেড়ে দেওয়া জনের মাছের মতো একলা খাবি খেতে খেতে আম্মার তারূণ্য, যৌবন কেটে গেলো। আমাদের বাড়িতে যে কতো অদ্ভুত রকমের নিপিড়ন আম্মার উপর চলতো তা বলে বোঝানো যাবে না। একে তো, আব্বার সঙ্গে রুচি আর অভ্যাসের অমিল, তার ওপর দাদার সাতাশ সাতাশ রকমের মানসিক চাপ।
একদিকে বিশাল গোষ্ঠীর হাঁড়ি সামলানো, দেবর ননদের নাকের সর্দি, গায়ের ময়লা পরিষ্কার করা, শার্টের বোতাম-জামার হেম সেলাই করা আর অন্যদিকে মামলা মোকদ্দমার তদবিরের দৌড় আবার সে সাথে নিজের রুচিবোধটা বাঁচিয়ে চলা।
মুখ দেখে কিছু বুঝে নেবেন তেমন মানুষ তো আব্বা নন, আবার মুখ খুলে কিছু বলবেন তেমন মানুষ আম্মা নন। তো, আম্মা একা একা কাঁদেন। আব্বা আসার সাথে সাথে চোখ মুছে স্বাভাবিক হাসি নিয়ে দাঁড়ান। এর কথা ওকে বলার রুচি তো আম্মার কোনদিনই ছিলে না, তারউপর আম্মা কোনভাবেই চাইতেন না, বাড়িতে কোনো অশান্তি হোক। সুতরাং নিজের হাতে নিজে খুন হওয়াটাই নিয়তি। আমার আম্মা...সারাটা জীবন অন্যের শান্তির জন্য নিজেকে শেষ করতে করতে আজ দাঁড়িয়ে আছেন কারবালার প্রান্তরে। নিজের জন্য সেই কারবালার প্রান্তর বানাতে বানাতে আম্মা গোলাপ বাগান সাজিয়েছেন আমাদের জন্য। নিজের হারানো সবকিছু দিয়ে আমাদের মানুষ বানিয়েছেন। সবচে সুন্দর জামাটা, সবচে ভালো স্কুলটা, সবচে ভালো কলেজটা...। নিজের একাডেমিক শিক্ষা খুব বেশি না থাকলেও মননের সমৃদ্ধি ছিলো তার বংশগত। তাই আম্মা আমাদের সব সময় যৌথ পরিবারের ঘেষাঘেষি, ঠেষাঠেষির মাঝে একদম আলাদা একটা বৃত্ত তৈরি করে বাঁচিয়ে রেখেছেন চুলার রাজনীতি, রেষারেষির নোংরামি আর নীচতা থেকে। তখন আম্মা বই পড়তেন অনেক। রোদ মরা বিকেলে পাড়ার সব বাচ্চারা যখন মাঠে খেলছে তখন আমরা দুই বোন সেজে গুজে চুলে ঝুঁটি বেঁধে আম্মার দুপাশে বসে শ্রুতলিপি করছি বা কবিতা পড়ছি। শিউলি মালা, রিক্তের বেদন, নৌকাডুবি, মেজদিদি, বড়দিদি, নন্দিত নরকে, বিশের বাঁশি, দেবদাস আম্মার মুখেই শুনে শেষ করেছি সেই ছোটবেলায়। নজরুলের ‘বাতায়ন পাশের গোবাক তরুর সারি’, মুখস্থ করেছি আম্মার মুখে মুখেই। কোন কোন রোদ মরা বিকেলে আম্মা গুনগুন করে গান গাইতো।
কী অদ্ভুত মন উদাস করা কণ্ঠ ছিলো আম্মার। আমার কাছে মনে হয় এসব গত জন্মের কোনো কথা। এ জন্মে আম্মা তো শুধুই সওয়াব গুণাহর দোলাচলে ‘মরণের আগে ও পরে’ পড়েন আর ওপারের তালিম নেন। আম্মার কথা লিখতে গেলেই আমি তোলপাড় করে আম্মার ভালো কোন ছবি খুঁজি। পাই না। আম্মার কোনো ভালো ছবি নেই। আম্মা বহুবছর প্রাণ খুলে হাসেন না। তাই ভালো ছবি হয় না। কক্সবাজারের সবচেয়ে অগ্রসর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা আম্মা, নজরুলের কবিতা মুখস্থ বলা আম্মা কখোন কীভাবে হাসতে ভুলে গেলো, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। আম্মার বুকে কি অনেক কান্না জমানো আছে? কখনো খুঁড়ে দেখিনি আম্মার বুকের ভেতরটা। জানি সে বেদনার তল খুঁড়ে বের করা আর হবেনা এ জীবনে। তবু এই পরিণত বয়সে এসে, যখন আমি নিজেও মা, আমি জানি ‘মা’ কী, এখন আমি শুধু চাই, আপনি আবার বাঁচেন। শুধু নিজের জন্য একবার বাঁচেন। আমাদের সেই অন্ধ বদ্ধ বাড়িতে আপনিই তো আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। আর আজ আপনার চারপাশে এতো আলো। কি নেই আজ আপনার? চারপাশে আলোর হাঁট রেখে কেন অকারণ বুক ধুপধাপ নিয়ে পুলসিরাতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আম্মা। আসেন আম্মা, জীবনে ফিরে আসেন। জীবনেও তো আযাবই পেলেন আম্মা, আযাবের ভয়ে মরছেন কেন তবে? দেখেন আম্মা, কতো সুন্দর, কতো আলো আপনার দরোজায় কড়া নাড়ছে। দরজাটা খুলেন আম্মা, বাচেঁন। প্রাণে বাঁচেন আম্মা, মনে বাঁচেন। ফেসবুক থেকে