আনোয়ার পারভেজ হালিম: সর্বহারা পার্টির ইতিহাসে পাদ্রিশিবপুর অধ্যায়টি বরাবরই আড়ালে থেকেছে। এই দলের প্রাপ্ত যাবতীয় দলিলপত্র এবং দলীয় নেতাদের লেখা বই ও নিবন্ধে বড়জোর দুইটি নাম মাসুম ও শেখর বা একটি বাক্যে স্থান পেয়েছে পাদ্রিশিবপুর। একাত্তরে যদিও ছোট ছিলাম, কিন্তু সেই সময়ের ঘটনা এখনও কমবেশি মনে আছে।
পর্তুগিজ আমল থেকে পাদ্রিশিবপুর একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা। মিশনারিদের কারণে এলাকাটি তখন থেকেই নানা কারণে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে এই এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে সেন্ট আলফ্রেড হাইস্কুলের অবদান রয়েছে। মিশনারি স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা সাধারণ স্কুলের তুলনায় একটু ব্যতিক্রমই। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, নাচগান, বির্তকসহ সমাজ সচেতনতামূলক সব বিষয়েই শিক্ষা দেওয়া হয়। এ কারণে এলাকাটি গ্রাম হলেও এখানকার শিক্ষার্থীরা বলা যায় বরাবরই অগ্রসর (অ্যাডভান্স) চিন্তাভাবনা নিয়ে গড়ে ওঠে। একাত্তরেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। যুদ্ধের ডাক এলে এলাকার তরুণসমাজ, এমনকি যারা শহরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন— যে যার মতো স্বাধীনতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। তাদেরই একজন ছিলেন মাসুম।
কৃষ্ণকাঠি গ্রামের মিয়ার বাড়ির মাসুম এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন কিনা জানি না। তিনি তখন বিএম কলেজে পড়তেন। তার বাবা আতাহার মিয়া ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী।পরিবারসহ বরিশালে থাকতেন।
যুদ্ধ শুরু হলে সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে সর্বহারা পার্টির সদর দফতর স্থাপন করে যুদ্ধে অংশ হন। মাসুম চলে আসেন পাদ্রিশিবপুরে।এলাকার সমমনা যুবকদের নিয়ে এখানে গড়ে তোলেন গেরিলা সংগঠন— সর্বহারা পার্টির শাখা বা ইউনিট। শ্রীমন্ত নদের পশ্চিম পাড়ে পাদ্রিশিবপুর- আর পূর্ব পাড়ে ভরপাশা গ্রাম। প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে কাঠের সেতুটি পার হলেই ডান পাশে ছিল পার্টির সদর দফতর। (পরে যখন পার্টি বিলুপ্ত হয় কৌতূহলের বসে বন্ধুদের নিয়ে সেতু পেরিয়ে আমি ওই সদর দফতর দেখতে গিয়েছি।)
আমার এখনও মনে আছে, এই দলের যোদ্ধারা লুঙ্গির ওপরে (প্যান্ট-পাজামা খুব কমই পড়তেন) হালকা আকাশী রঙের চারটি পকেটের ফুলহাতা ইউনফর্ম পরতেন। তাদের কাঁধে ঝুলানো থাকতো একনলা- দোনলা বন্দুক। রাইফেল খুব কমই দেখেছি। আর সঙ্গে থাকতো ড্যাগার (চাকু)। যতদূর জানি, তাদের কোনও আধুনিক অস্ত্র ছিল না। তারা বন্দুকগুলো সংগ্রহ করেছিলেন পাদ্রিশিবপুরসহ আশপাশের এলাকা প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য পরিবার থেকে। তখনও এলাকায় সর্বহারা পার্টি ব্যতীত অন্যকোনও মুক্তিবাহিনীর আগমন ঘটেনি।
মাসুমের দলে দুই জন মাহবুব ছিলেন। একজন মাসুমের ছোট ভাই মাহবুব আলম, অপরজন মাহবুবুর রহমান খসরু (মহিব্বর)। মূলত মাসুম ছিলেন প্রধান, তার সহযোগী মাহবুব ও খসরু। এই তিন জনই ছিলেন এ দলের প্রধান লিডার।
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, পাদ্রিশিবপুর মিশনারিতে বিদেশিরা থাকতেন। একাত্তরে এই মিশনারির প্রধান ছিলেন ফাদার জার্মান। মাসুমের দলের প্রতি মিশনারিদের সমর্থন ছিল। খ্রিস্টান যুবকদের অনেকে এ দলের সদস্য ছিলেন। মূল নেতারা নিরাপত্তার কারণে রাতে বেলায় খ্রিস্টানপাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে গোপন আস্তানায় থাকতেন। মিশনারিদের সমর্থন ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না।
সর্বহারা পার্টির পত্তনের কিছুদিনের মধ্যে এলাকায় শুরু হয় অভিযান। চোর, ডাকাত, টাউট, বদমাসদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের ভাষায় এরা ছিল শ্রেণিশত্রু। নৌকায় করে রাতের বেলায় বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হতো কানকি পেরিয়ে আলগির নদীতে (এটাই কি পায়রা!)।সেখানে তাদের খতম করা হতো। এই খতমের কাজটি যিনি করতেন তার নাম গৌরঙ্গ। শুনেছি, মূলত তিনি বিষক্ত চাকু দিয়ে কুপিয়ে শত্রু খতম করতেন। এ কারেণ সেসময় এলাকায় তার নাম হয়ে যায় জল্লাদ গৌরঙ্গ।
দেখা গেলো, কিছু দিনের মধ্যেই এলাকায় চুরি-ডাকাতি বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বহারাদের কারণে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে শান্ত। তবে শ্রেণিশত্রুর নামে তাদের হাতে অনেক নিরীহ মানুষও খতম হয়েছে। অন্তত দুটি নাম বলতে পারি— আমার চাচাতো ভাই সেলিম জোমাদ্দার ও অপর জন প্রতিবেশি চাচা মহব্বত আলী জোমাদ্দার। একদিন আমাদের কালিগঞ্জ বাজারে এলো সর্বহারা পার্টি। তারা সেলিম ভাইকে ধরে তাদের নৌকায় নিয়ে ওঠালো। তাকে আর ফেরত পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, ওই নৌকায় থাকা বোমা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটলে সেলিম ভাই তাতে মারা যান। প্রায়ই গুজব উঠতো বাজার মিলিটারি আসতেছে।এই গুজবে যে যেভাবে পারে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতো। বর্ষাকাল। একদিন শোনা গেলো বাজারে মুক্তিবাহিনী এসেছে। মহব্বত চাচা আমাদের উঠানের ওপর দিয়ে বাজারে যাচ্ছেন, সাদা ধবধবে পাঞ্জাবির সঙ্গে পরনে প্লেকার্ড লুঙ্গি আর হাতে ছাতা। মা বললেন, ‘ভাই কোথায় যাচ্ছেন?’ চাচা বললেন, ‘বাজারে ছেলেরা এসেছে— যাই দেখে আসি ওরা কারা?’ সেই যে গেলেন তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে জেনেছি, সর্বহারা পার্টি তাকে খতম করেছে।
পাদ্রিশিবপুর থেকে বাকেরগঞ্জ থানা সদরের দূরত্ব সাড়ে তিন মাইলের মতো। সেখানে মিলিটারি ও রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি। তারা কলসকাঠির হিন্দুপাড়া আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুটপাট করেছে, অনেক মানুষ মেরেছে। শ্যামপুরসহ আরও দুয়েকটি এলাকায় তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। কালিগঞ্জেও হিন্দুবাড়ি লুটপাটসহ পুড়িয়ে দিয়েছে, তবে কোনও মানুষ মারেনি। থানা সদরের অবস্থান এত কাছে হলেও মিলিটারি বা রাজাকারদের সঙ্গে সর্বহারা পার্টির কোনও সংঘর্ষ বা যুদ্ধ হয়নি,এমনকি কখনও এই দুই পক্ষ মুখোমুখিও হয়নি।
তারপর সেপ্টেম্বর কী অক্টোবরের দিকে এলাকায় মুক্তিবাহিনী এসেছে বলে কানাঘুষা চলছিল। তারা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একটি ছিল দুধলমৌর তৈমুর গাজীর বাহিনী (এই বাহিনী ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত কিনা আমি নিশ্চিত না)। তৈমুর ছিল ডাকাত প্রকৃতির লোক। একদিন সকালে (তারিখ মনে নেই) খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, মাসুমকে তার বডিগার্ডসহ হত্যা করা হয়েছে। পরে যা জানা গেলো, তা হলো— তৈমুর বাহিনী মাসুমকে হত্যা করেছে। তার আগে তারা মাসুমের দলের জল্লাদ গৌরঙ্গকে হাত করে নেয়। এই গৌরঙ্গই ঘাতকদেরকে মাসুমের আস্তানা চিনিয়ে দিয়েছিল। রাতের বেলা বডিগার্ড শেখরসহ মাসুমকে আস্তানা থেকে ডেকে এনে ফাঁদে ফেলে হত্যা করে। পরে শুনেছি, শত্রুদের ঘেরাও অবস্থায় তাদেরকে ডেগার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিলেন গৌরঙ্গই। শেখরের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া বা গৌরনদীতে। শেখর কি পার্টির নাম নাকি আসল নাম, তাও জানা যায়নি। পাদ্রিশিবপুর সরকারি ডাক্তার খানার পাশেই মাসুম ও শেখরকে দাফন করা হয়। মনে আছে, ছোটবেলায় প্রত্যেক বিজয় দিবসে আমরা এই দুই দেশপ্রেমিকের কবরে ফুল দিতাম।
যেদিন মাসুম ও শেখরকে হত্যা করা হলো, মূলত সেদিন থেকেই সর্বহারা পার্টি- পাদ্রিশিবপুর শাখা বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেকে দেখেছেন, সেদিন সকালে ফাদার জার্মান গির্জার ঘাট থেকে স্পিডবোটে করে মাহবুব ও খসরুকে নিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছেন। পরে অবশ্য জানতে পারি, তাদেরকে বরগুনার মহিপুরের মিশনারিতে নিয়ে নিরাপদে রেখে এসেছিলেন ফাদার জার্মান। সেখান থেকে আরও পড়ে তারা বরিশালে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
এই ঘটনার কিছুদিন পর একদিন সকাল ১০/১১টার দিকে আমাদের বাড়িতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল এসে হাজির। তারা সর্বহারা পার্টির নেতা খসরুদের (তিনি আমার বাবার আপন খালাতো ভাই, আমরা একই বাড়িতে থাকি) ঘরে লুটাপাট শুরু করে। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। এরমধ্যেই ঘরের যাবতীয় আসবাব, এমনি দালানের টিনের চাল পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। ৪/৫টি বড় ধানি নৌকায় লুটের মালামাল বোঝাই করে তারা চলে যায়। পরে জেনেছি, এই বাহিনীর সদস্যরা সবাই ক্যাপ্টেন ওমর বাহিনীর। তাদের মধ্যে হলতা-নীলগঞ্জের জাফরও ছিলেন (যিনি ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করতে গিয়ে রক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন,(তখন তিনি জাসদ করতেন )।
স্বাধীনতার পর সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে দুই জন মাহবুবের (একজনের ছদ্ম নাম সুলতান) কথা দলটির বিভিন্ন দলিলপত্রে পাওয়া যায়। এরাই মাসুমের ছোট ভাই মাহবুব এবং মাহবুব (খসরু) কিনা, আমি তা আজও জানতে পারিনি। আমার চাচা মাহবুবুর রহমান খসরু (মাহবুব) পরিপূর্ণ বয়সে মারা গেছেন। আমি কয়েকবার তার কাছে তখনকার ঘটনা জানতে চাইলেও তিনি মুখ খোলেননি। ভীষণ বিব্রত হতেন। আর মাসুমের ছোট ভাই মাহবুব আলম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিতে ছিলেন। তিনি বাকেরগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০২০ সালে এই মাহবুব ঢাকায় মুত্যুবরণ করেন।
বি. দ্র: ১৯৮২ সালে আমি একরাতের জন্য বরিশাল জেলে ছিলাম। আমদানি ওয়ার্ডে পরিচয় হয় আমার সমবয়সী এক তরুণের সঙ্গে। সে ইন্টারে পড়ে। তার বাড়ি আগৈলঝাড়া বা গৌরনদীতে। সে জানায়, তার কাছে একটি বুলেটের খোসা পাওয়ায় পুলিশ মামলা দিয়ে তাকে জেলে ঢুকিয়েছে। কথাবার্তায় তরুণটিকে বেশ ট্যালেন্ট মনে হলো। কথা প্রসঙ্গে আমি পাদ্রিশিবপুর স্কুলের ছাত্র ছিলাম শুনে সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, যেন আমি তার খুব কাছের কেউ। তার আচরণে একটু অবাকই হলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় সহবন্দি এই তরুণ জানায়, পাদ্রিশিবপুরে তার চাচার কবর রয়েছে। একাত্তরে মারা গেছেন— নাম শেখর। এই কাকতালীয় ঘটনায় আমিও সেদিন ভীষণ আবেগতারিত হয়েছিলাম। পরদিন সকালে আদালতে জামিন হলে আমি ঢাকায় চলে আসি। আমার ধারণা ছিল আদালত থেকে আবারও জেলে ফেরা হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় ওই তরুণের নাম-ঠিকানা বা বিস্তারিত কিছুই আর জানার সুযোগ হয়নি। সে সময় গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় সর্বহারার পার্টির ব্যাপক প্রভাব ছিল। আমার ধারণা এই তরুণটি ছিল সর্বহারা পার্টির সদস্য। হয়তো চাচার পথ ধরেই সে এই দলে নাম লিখিয়েছিল।
(এই লেখাটি বেশিরভাগ শৈশবের স্মৃতিনির্ভর। তথ্যে হয়তো ২/১টি ভুল থাকতেও পারে। যারা পাদ্রিশিবপুর সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এখনও জীবিত আছেন তারা, বা তাদের সন্তান যারা বাবার মুখে সে সময়ের গল্প শুনেছেন, তাদের কাছেও তথ্য দেওয়ার আহ্বান থাকলো। সংশোধন ও যুক্ত করে দেবো। যদি কেউ মাসুম ও শেখরের কবরের ছবি তুলে পাঠান কৃতজ্ঞ থাকবো। )
parvezhalim1@gmail.com