ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: ৬ কোটি ৬০ লাখের দেশ যুক্তরাজ্য। করোনা মহামারীতে ইউরোপের ভেতর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এটি, যেখানে গত এক বছরে কোভিডে মারা গেছে ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষ। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশটি রয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়ের ভেতরে। একদিকে ব্রেগজিট, আরেক দিকে করোনা। এত কিছুর পরও দেশটি ঘুরে দাড়িয়েছে। জানুয়ারিতে টিকা কার্যক্রম শুরু করে মার্চের ভেতরে দেশের অর্ধেক মানুষকে অন্তত একটি ডোজ টিকা দিয়ে ফেলেছে। সকল স্বাস্থকর্মী এবং ৮০ বছরের উপরে ঝুঁকিপূর্ণ সবাইকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সেরোসার্ভাইল্যান্সে দেখা গেছে গোটা যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরী হয়েছে! অর্থাৎ দেশটির অর্ধেক মানুষ এখন করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ইমিউন। এটা সম্ভব হয়েছে করোনা সংক্রমণ এবং দ্রুত চাতুর্যপূর্ণ টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে। এভাবে আগামি দুই মাসের ভেতরে আরো ২০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পারলেই দেশটিতে করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যেই এগোচ্ছে বরিস জনসন।
চিকিৎসা দিয়ে করোনার মত ভয়াবহ মহামারী দমন করা সম্ভব নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মত চিকিৎসা সেবায় উন্নত দেশগুলো। মহামারী প্রতিরোধে দরকার ইপিডেমিওলজিক্যাল প্ল্যানিং এবং ইম্প্লিমেন্টেশন। দরকার দীর্ঘমেয়াদী প্লান এবং তার বাস্তবায়ন।
এতকিছুর পরও যুক্তরাজ্য সরকার স্বস্তিতে নেই। লকডাউন এবং ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে দ্বিতীয় ওয়েভকে সম্পূর্ন বশে আনতে পারলেও, সতর্ক রয়েছে তৃতীয় ওয়েভের জন্য। কারণ এটা নিশ্চিত, চলমান লকডাউন সম্পূর্ন তুলে নেয়ার পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে। ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিংয়ের মাধ্যমে এমনটিই ইংগিত দিয়েছেন দেশটির সাইন্টিস্টগণ।
অন্যদিকে ইউরোপ করোনা মোকাবেলায় তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। এর প্রধান কারণ তাদের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামের প্লানিং এবং তা বাস্তবায়নে চাতুর্যতার অভাব। জার্মানি এবং ফ্রান্সের মত দেশ তাদের মাত্র ১০-১২ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে সক্ষম হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো এখন আরেকটি মারাত্মক করোনা ওয়েভের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশগুলোর সম্মুখ সাঁরির নেতারা রাজনীতির নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়ে তারা পলিটিক্স করছে। তাদের কর্মকান্ডে শুধু ইউরোপ নয়, গোটা বিশ্বের মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হচ্ছে, যা কিনা এই মহামারী দমনে অন্তরায়।
বাংলাদেশ এতদিন চলেছে এক ধরণের আত্মতুষ্টির মধ্যে দিয়ে। দেশের মানুষের মধ্যে দেখা গেছে করোনার প্রতি চরম ঔদাসিন্য, যেন কোন মহামারী নেই দেশে বা পৃথিবীতে! একেকজন হার্কিউলিয়ান মনোভাবের মানুষ ভাইরাসটিকে নস্যি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে। এর ফলাফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দেশটিতে করোনা মহামারী জেঁকে বসেছে বেশ ভাল ভাবেই। প্রতিটি জেলায় ভাইরাস ছড়িয়ে পরছে হুহু করে। এর শেষ কিভাবে হবে জানা নেই।
শুধু এতটুকু বলতে পারি। হারকিউলিস হোন আর যাই হোন, মাস্ক পরিধাণ করুন সঠিকভাবে এবং সর্বদা। সামাজিক দুরত্ব মেনে চলুন। স্বাস্থবিধি মেনে চলুন যথাযথভাবে। ভ্যাকসিন না নিয়ে থাকলে কালই গিয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে নিন। নিজে বাঁচুন, আপনার পরিবারকে বাঁচান। এতেই আপনার দেশ বেঁচে যাবে এ যাত্রায়।
লেখক : এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য