আনোয়ার হোসেন: [২] ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা। ভৌগোলিকভাবে যার দুই তৃতীয়াংশই চর। এখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মান অনুন্নত। জীবন জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা তাদের নিত্য দিনের কাজ। নদী ভাঙ্গনের ফলে চর থেকে অনেকেই অবস্থান নিয়েছে সরকারি বাঁধে ও স্থাপনায়। চারদিকে যখন স্বপ্নের বেড়াজালে মানুষের জীবন ঢেউ খাচ্ছে সেই স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা করছেন সুভাষ চন্দ্র বর্মন।
[৩] পৃথিবীর মানুষ গুলো যখন নিজ নিজ স্বার্থের পিছনে ছুটছেন শুধু নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য আর অনেকেই মানুষকে শুধু শোনাচ্ছেন ভাগ্য পরিবর্তনের গান। তখন সুভাষ তার ব্যতিক্রম, শুধু নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নয় সকল মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনও করতে চান তিনি। এ সকল নিম্ন আয়ের মানুষের কর্ম দিয়ে তাদের জীবনের পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন তিনি।
[৪] জেলার সদর উপজেলা তালতলা,দাড়িয়াপুর ও ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনের পাড়ায় গড়ে তুলেছেন কচুরিপানা ভিত্তিক হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গুলোতে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪টি গ্রামের আড়াই’শ দরিদ্র্য নারী যুক্ত হয়েছেন এই পেশায়। জেলার তালতলা, দাড়িয়াপুর কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ভাষানচর, মদনের পাড়া, বাগুড়া গ্রামের সবুজে ঘেরা প্রতিটি বাড়ির উঠানে এখন নারীদের মিলন মেলা। দুর থেকে বোঝার কোন উপায় নেই গোল হয়ে আঙ্গিনায় বসে কি করছেন তারা। কাছে গেলে দেখা যায় গবাদি পশুর খাদ্য কচুরিপানা দিয়ে তৈরী করছেন ,ফুলের টব, ঝুড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগ মাদুরসহ ঘর সাজানোর বিভিন্ন সৌখিন সামগ্রী ।
[৫] ফেলে দেওয়া পচনশীল, গবাদী পশুর খাদ্য এবং শুকনা কচুরী পানাকে নান্দনিক রুপ দিয়েছেন গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা । তাদের নিপুণ হাতের ছোয়ায় কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে মূল্যবান সৌখিন ঘর সাজানোর সামগ্রী। বিক্রি হচ্ছে দেশ পার হয়ে বিদেশের মাটিতে। আর একাজ করে নারীরা এগিয়ে নিচ্ছেন তাদের স্বল্প আয়ের সংসারকে ।
[৬] গাইবান্ধা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দুরে ফুলছড়ি উপজেলা কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনের পাড়া নিভৃত এক পল্লীতে ২৫-৩০ জন মহিলা কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করছেন ফুলের টব, ঝুড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগ, মাদুর। সেখানে কথা হয় মৌসুমী আকতার তমা নামে হস্তশিল্পের এক কারিগরে সঙ্গে। তিনি বলেন , কচুরিপানার দিয়ে সুন্দর সুন্দর ব্যাগ, ফুলের টব, ঝুড়ি তৈরী করা যায় তা শুনছেন একজন প্রতিবেশীর কাছে। কচুরিপানা দিয়ে এ গুলো কিভাবে তৈরি করা যায় তার মনের ভেতরে আগ্রহ জন্মে। কচুরিপানার হস্তশিল্প শেখার জন্য তিনি মদনের পাড়া সুভাষ চন্দ্র বর্মনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান এবং কাজ শেখেন। কাজ শেখার পর তিনি এই হস্তশিল্পের কাজ শুরু করেন। সাংসারিক কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে কচুরিপানা দিয়ে বিভিন্ন ধরনে ব্যাগ ,ঝুড়ি, ফুলের টব তৈরী করে দৈনিক আড়ই’শ থেকে তিনশ টাকা আয় করেন।
[৭] এই ইউনিয়নের ভাষানচরে হঠাৎপাড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ষাট-সত্তর জন নারী একাজের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সেখানে কথা হয় কিশামত ফলিয়া গ্রামের হস্তশিল্পের ট্রেইনার আশুরার সাথে। তিনি বলেন, এ কেন্দ্রে যারা কাজ শিখছেন তারা এ বিষয়ে অবগত নন , হাত ধরে ধরে তাদের কাজ শিখাতে হচ্ছে , অনেকেই কাঁচামাল নষ্ট করছেন, তার পরও তো শিখাতে হবে। তিনি আরো জানান, প্রথমে এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণার্থীরা ভুল করে ,পরে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। প্রথমে শিখাতে খারাপ লাগলেও , শেখার পর যখন তারা আয় করতে পারেন তখন খুব ভালো লাগে।
[৮] এ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন গাইবান্ধা সরকারী মহিলা কলেজের ডিগ্রি ২য় বর্ষের ছাত্রী ফারজানা আকতার ববি। তিনি জানান পড়াশুনার পাশাপাশি এ কাজ শিখছি। এ কেন্দ্রে ৫ দিন হলো আমি প্রশিক্ষণ নিচ্ছি , মোটামোটি কাজ শেখা প্রায় শেষ। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গত দুই দিন থেকে ২০০-২৫০ টাকার কাজ করতে পারছি। তিনি বলেন, মেয়েরা পড়াশুনার ফাঁকে অবসর সময়ে এ কাজ করে অর্থ আয় করতে পারবেন।
[৯] বাগুয়া গ্রামের কচুরিপানার হস্তশিল্পের কর্মী মোর্শেদা বেগম বলেন, সংসারের কাজ-কর্ম করার পর অবসর সময়ে এ কাজ করি । তারপরও আমার মাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা আয় হয়। হাতের কাছে কাজ তাই সমস্যা হয় না।
[১০] কচুরিপানার হস্তশিল্প কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী.সুভাষ চন্দ্র বর্মন জানান, ২০০০ সালে গাজীপুর পূবাইলে একটি গার্মেন্টস কারখানায় তিনি চাকুরী নেন। কিছুদিন পর তার মা দুর্ঘটনার শিকার হয়। চাকুরির পাশাপাশি মায়ের চিকিৎসার সেবা করেন। অনেক চেষ্টা করেও তার মাকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। তার মা মারা যাওয়ার এক মাস পর তার স্বপ্নের চাকুরিটি চলে যায়। এক পর্যায়ে আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকেন। একদিন এক সাইন বোর্ডে দেখতে পান হস্তশিল্প তৈরীর কারখানা। সেখানে গিয়ে কথা বলে কাজ শেখেন এবং দৈনিক ইনকাম করা শুরু করেন। ঐ কারখানায় প্রায় পাঁচ বছর কাজ করার পর চলে আসেন ২০১৬ সালে গাইবান্ধার ফুলছড়ির উপজেলার মদনের পাড়ায় শশুর বাড়িতে।
[১১] প্রথমে ২৫ জন মহিলা দিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন তার চারটি কারখানায় দৈনিক এক’শ জন হস্তশিল্প কর্মী কাজ করছেন। পণ্যর আকারের উপর ভিত্তি করে মজুরি দেন। প্রতিটি পণ্য সামগ্রী তৈরিতে ২০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত দেন। তার কারখানার তৈরিকৃত পণ্য সামগ্রী গাজীপুর সেনা কল্যাণ ইকোবাংলা জুট মিল লিমিটেড কোম্পানি বিক্রয় করেন। বর্তমানে প্রতি মাসে দশ থেকে বারো লাখ টাকার কচুরিপানার হস্তশিল্প পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করেন।
[১২] ইকোবাংলা জুট মিল থেকে এসব পণ্য নেদারল্যান্ড,আমেরিকা,কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেন। সুভাষ চন্দ্র বর্মন বলেন সরকার থেকে সহযোগিতা পেলে এ হস্তশিল্পের প্রসার ঘটিয়ে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। সম্পাদনা: অনন্যা আফরিন