আহসান হাবিব: যখন কোনো মানুষ কোনো কিছুতে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে, লোকে তখন বলতে ভালবাসে যে এ প্রতিভা ‘গড গিফটেড’ অর্থাৎ এটা ঈশ্বর প্রদত্ত। লোকের কথায় এমন মনে হয় যে ঈশ্বর এটা বেছে বেছে কিছু মানুষকে দিয়েছে তার মর্জি মাফিক এবং ফলে সেটাই সে করে দেখাচ্ছে। তাদের কথায় এটাও প্রমাণিত হয় যে ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেন না, বেছে বেছে দেন। যুগে যুগে যেমন তিনি মহানবী পাঠিয়েছেন, তেমনি এমন কিছু মানুষ তৈরি করেছেন যাদের প্রতিভা মানে সৃষ্টি করার ক্ষমতা অন্যদের চাইতে আলাদা। কেন তিনি সবাইকে তা দেননি, এটা বোঝা সম্ভব নয়, কারণ এটাই তার লীলা। তার লীলা বোঝা মানুষের কাজ নয়। কতো সহজ ভাবনা, তাই না? প্রতিভাধর একজন মানুষের শ্রম, সাধনা, কষ্ট ইত্যাদিকে এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে সব কৃতিত্ব ওই অদেখা ঈশ্বরকে দিয়ে দেওয়া কতো সহজ। অথচ যেকোনো একজন এমন মানুষের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখুন তাদের নিরলস পরিশ্রম। দিনের পর দিন কীভাবে একটা জিনিসকে আয়ত্ব করার জন্য চেষ্টা করে গেছে। যখন সেটা অনায়াসে হয়েছে, মানুষ সেই অনায়াসলব্ধ ফলটুকু দেখেছে কিংবা শুনেছে আর বলে উঠেছে ‘গড গিফটেড’।
একটা সহজ উদাহরণ দিচ্ছি, মনে করুন আমাদের শরীরের একটা অঙ্গের নাম ভোকাল কর্ড যা আমাদের ধ্বনি উৎপাদনে কাজ করে। সকলের ভোকাল কর্ড আছে, সকলেই কথা বলে, কিন্তু সবার কণ্ঠস্বর আলাদা। কেন আলাদা জানতে হলে বস্তুর ধর্ম বা গুণ জানতে হবে। কেন প্রতিটি মানুষের কণ্ঠস্বর আলাদা এটা নির্ভর করছে ভোকাল কর্ডের দৈর্ঘ্য ঘনত্ব এবং সুস্থতার উপর। দেখা গেছে ভোকাল কর্ডের ঘনত্ব এবং দৈর্ঘ্য যার যতো বেশি তার কণ্ঠস্বর ততো মোটা মানে ভারী। আমরা যখন কোনো পুরুষের ভারী কণ্ঠস্বর শুনি, মুগ্ধ হই কিন্তু সেই ব্যক্তিই যখন কোনো গানের কলি গেয়ে ওঠে, হেসে উঠি, কারণ কি? কারণ সুর তার আয়ত্বে নেই। আবার কণ্ঠস্বর তুলনামুলক চিক্কণ, কিন্তু তার গান শুনতে অসাধারণ লাগে, কেন? কারণ তার গলায় সুর খেলা করছে। তাহলে কণ্ঠস্বর কোনো বিষয় নয়, দুজনেই পেয়েছে সেই তথাকথিত ঈশ্বরের কাছ থেকে কিন্তু সুর আয়ত্ব করার সাধনায় আলাদা হয়ে গেছে স্বরের প্রয়োগ। এ স্বর প্রয়োগের কাজে দেখা গেলো মানুষটির জীবনের অর্ধেক সময় কেটে গেছে। এইযে অর্ধেক সময় কেটে গেলো এটা মানুষ সাধারণত দেখে না, দেখে তার ফলটুকু এবং বলে বসে ‘গড গিফটেড’। প্রকৃত প্রস্তাবে একটা চিক্কণ কণ্ঠের মানুষ যেমন একটা মোটা কণ্ঠের অধিকারী মানুষও তেমনি একই কাজ করতে সক্ষম হবে যদি তারা সেই কাজের পেছনে সঠিক সাধনা এবং পরিশ্রম যুক্ত করে। পরিশ্রম, সাধনা নেই, কোনো ফলাফল নেই, ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো বাহাদুরিও নেই।
প্রতিটি মানুষ একই জিনিস পায় জন্মসূত্রে, বদলে যায় কাজের সূত্রে। আর প্রতিটি মানুষের রয়েছে আলাদা আলাদা পছন্দ, সেই পছন্দ অনুসারে যদি উপযুক্ত শ্রম ব্যয় করা যায়, ফলাফল আসবেই। বলা হয় একজন মানুষ যা করতে পারে, অন্যজন তাই করতে পারে যদি ওই কাজের জন্য যা করা প্রয়োজন সে তা করে। আমি যদি মান্না দে অথবা রশিদ খাঁর মতো অসাধারণ সংগীত পরিবেশন করতে চাই, তারা যে পরিশ্রম এবং সময় ব্যয় করেছেন, আমাকে তাই করতে হবে। পার্থক্য যা হবে তা হলো পরিবেশনার ভঙ্গিতে। এর মানও আলাদা হবে কিন্তু মৌলিকভাবে জিনিসটি একই হবে- সংগীত। শিল্পবোধ পার্থক্য করে ফেলবে এর অনন্যতা। সুতরাং ‘গড গিফটেড’ একটি ভুয়া ধারণা, সবই পরিশ্রম এবং সাধনার ফল। এখন কে হবে সংগীতকার কিংবা বিজ্ঞানী কিংবা খেলোয়াড় এটার আলোচনা অন্য। এখানেও ঈশ্বরের কোনো হাত নেই। আর একটি বস্তু কেন আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, সে আলোচনাও ভিন্ন, অন্যত্র করা যাবে। আপাতত ‘গড গিফটেড’ এর অসারতা সম্পর্কে এটুকুই। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :