লিহান লিমা : [২] মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মধ্যে ৪৩জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। অধিকার জানায়, গত চার বছরের তুলনায় ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯৬৩টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়, তবে বলার অপেক্ষা রাখে না অনেক নারীই ভয়ে মামলা থেকে বিরত থেকেছেন।
[৩] ধর্ষণ বাংলাদেশে মহামারীর মতোই আকার ধারণ করেছে, জাতিসংঘ সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদ্যমান শিথিল ও ধীর বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।
[৪] হার্ভাডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ২ লাখ নারীকে ক্যাম্পে আটক রেখে ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র বানিয়েছিলো। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতেই নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার হার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ক্রমবর্ধমান এই সহিংসতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে রয়েছে অকার্যকর বিচার ব্যবস্থা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও মাদকাসক্তি।
[৫] প্রথমত, বাংলাদেশের বিদ্যামান বিচার ব্যবস্থায় আদালত ধর্ষণ মামলায় অপরাধী অভিযুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়া সহ ভুক্তভোগীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৬টি বিভাগে দায়ের করা ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে মাত্র ৫টির বিচার হয়েছে। অবৈধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, জটিল ও দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন এবং অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুয়া মামলাসহ অনেক কারণে আইনজীবীরা অপরাধীকে অভিযুক্ত প্রমাণ করতে পারেন না। তবে এই সব কারণগুলের মধ্যে অন্যতম অবৈধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি।
[৬] দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয় পুরুষ আগ্রাসী ও দমনমূলক ব্যবহার দেখাতে পারেন এবং নারী নত, বাধ্যগত ও যত্নশীল থাকবেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণকে মূলত সমাজে পুরুষের ক্ষমতার প্রতিপত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ‘ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস’ ধর্ষকদের সাক্ষাতকার নিয়ে দেখেছে, বেশিরভাগ ধর্ষকই স্বীকার করেছেন, তারা যৌন আনন্দের জন্য নয়, নিজের ক্ষমতা ও শক্তি দেখাতে ধর্ষণকে উপভোগ করেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আরেকটি জঘন্য দিক হলো ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ অফিসার, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাদের সাক্ষাতকার নিয়ে দেখা গিয়েছে, তারা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক ও চলাফেরাকেই দায়ী করেন। এই মানসিকতার কারণে ভুক্তভোগীরাই সমাজের কাছে অপরাধী প্রমাণিত হয়, এই আশঙ্কা থেকে অনেক নারী যৌন হয়রানির ঘটনা গোপন রাখেন।
[৭] সবশেষে ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে মাদকের। বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে, ইয়াবা বা এ জাতীয় মাদকদ্রব্য যৌন আগ্রাসী মনোভাব বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকারের জরিপেও দেখা গিয়েছে, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার অপরাধীদের ৮০ভাগই মাদকাসক্ত।
[৮] ধর্ষণের মতো যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে এই প্রতিবেদনে চারটি সম্ভাব্য উপায়ের কথা বলা হয়। প্রথমত, বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশ ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড জারি করলেও এটি কার্যকরী নয়, কারণ এই সাজা ধর্ষককে ভুক্তভোগীকে হত্যা করে প্রমাণ লোপাটে প্ররোচিত করবে। সঠিক বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিতে প্রয়োজন দ্রুত বিচার নিশ্চিত ও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ।
[৯]দ্বিতীয়ত, ধর্ষণ থেকে সুরক্ষার জন্য নারীকে এককভাবে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের জন্য জোর দেয়ার পরিবর্তে পুরুষকে শেখাতে হবে কেনো তাদের যৌন হয়রানি করা উচিত নয়। স্কুল-কলেজগুলো পুরুষ শিক্ষার্থীদের যৌন শিক্ষা দেয়াসহ নারীকে সম্মান করা সহ নৈতিকতা বোধের শিক্ষা দিতে হবে।
[১০]তৃতীয়ত মাদকাসক্তি প্রতিরোধে কঠোর সীমান্ত নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ মাদক পাচারের রুটগুলো বন্ধ, মাদকব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারীভাবেও মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা জোরদার করতে হবে।
[১১]চতুর্থ বিষয় হলো সামাজিক পরিবর্তন। ধর্ষণের জন্য একমাত্র পুরষই দায়ী। বাংলাদেশে ভুক্তভোগীকে দোষারোপের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা সহ লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভুক্তভোগীকে মানসিক সহায়তা দেয়াসহ তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নারীর জন্য বাংলাদেশ আরো নিরাপদ হবে।
আপনার মতামত লিখুন :