আরিফুজ্জামান তুহিন : ড্রাগ নেওয়ার কারণে ম্যারাডোনা যে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েন তখন আমি কিশোর। ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করি। আমার বন্ধুদের সাথে সেদিন গলা ছেড়ে খুব কেঁদেছিলাম। পুরুষ মানুষের বয়স হলে ‘পুরুষতন্ত্র’ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা তাকে শেখায়, দুর্বল মানুষ কাঁদে। পুরুষের কান্না মানায় না। দিয়াগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবরে এই মধ্য বয়সে খুব কান্না পাচ্ছে। আমি গাড়িতে বসে আছি। সচিবালয় যাচ্ছি।
মুঠোফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। বিভিন্ন মানুষ ও মিডিয়া নানাভাবে দিয়োগোর মৃত্যুর খবর লিখছে। খুব কান্না পাচ্ছে, কিন্তু শব্দ করে কান্না করতে পারছি না। দিয়াগোকে শেষ ভালোবাসা জানাতে হাজার হাজার মানুষ আসছে আর্জেন্টিনার রাজধানীতে। রাশিয়ার টিভি আরটি লাইভ করছে। আমি সেদিকে তাকালাম। দেখলাম মানুষ তার কফিনের সামনে গিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সালাম জানাচ্ছেন। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা এভাবে সালাম দেয়। আমরা একে লাল সালাম বলি। টেনস নাইট নাইট নামে একটি টিভি শো করতেন ম্যারাডোনা।
টিভি শোতে দিয়াগো যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করতেন। ...সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধাপরাধী জর্জ বুশ আর্জেন্টিনা সফরে যান। দিয়াগো জর্জ বুশ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন। তখন তিনি বুশকে ‘মানব বর্জ্য’ আখ্যা দিয়েছিলেন। যদি দিয়াগো বাঙালি হতেন তাহলে আমার ধারণা তিনি বুশকে ‘গুয়ের দলা’ বলতেন। ইসরায়েলের জায়নিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দিয়াগো ম্যারাডোনা ছিলেন নিপীড়িত প্যালেস্টাইনদের পক্ষে। সেটি তিনি খোলামেলাভাবে বলেছেন।
ম্যারাডোনার ডান বাহুতে ছিলো চে গুয়েভারা। আর বাম পায়ে ছিল ফিদেল কাস্ত্রো। চে ও ফিদেল পরম বন্ধু ছিলেন। ফিদেলকে কিউবাতে রেখে বিশ^ বিপ্লবের উদ্দেশ্য বলিভিয়াতে সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতা করতে গিয়ে ধরা পড়েন। নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। চে মরে গিয়ে গোটা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের হয়ে গেছে। ফিদেল কাস্ত্রোর নামে নাম সংগীত করে না কিউবা। তিনি বেচে থাকতে মানা করেছিলেন।
আমার ধারণা ফিদেল কিউবাতে ততোই উজ্জ্বল হবেন যতো দ্রুত কিউবার সমাজে মানুষ আরও শক্তিশালী হবে। ফিদেলের মৃত্যুর পর ম্যারাডোনা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, আমার কাছে ফিদেল ছিলেন দ্বিতীয় বাবার মতো। আর্জেন্টিনায় যখন আমার সামনে দরজাগুলো বন্ধ হচ্ছিল, তখন তিনি কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন। লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ ভেনেজুয়েলা, সেখানে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায়। দিয়াগো বারবার ভেনেজুয়েলাতে ছুটে গেছেন। তীব্র সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের।
দিয়াগো পুঁজিবাদী দুনিয়ার আইনের বাইরে একজন মানুষ। পুঁজিবাদ জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের যেসব আইন কানুন বেঁধে দিয়েছে দিয়াগো সেখানে বেমানান। একটি বেআইনি গোল দেওয়ার জন্য তার সমালোচকেরা তাকে নিন্দেমন্দ করেছে। কিন্তু বিষয়টি আমি দেখি অন্যভাবে। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কোনো নিয়ম মানে না, সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে অগন্তি মানুষের হত্যা ও ক্ষুধার জন্য দায়ী। বরং সেই সাম্রাজ্যবাদের মুখে এটি দিয়াগোর থাপ্পড় নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রিয় কমরেড দিয়াগো ম্যারাডোনা মৃত্যুর খবরে আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, শব্দ করতে পারছি না। ভীষণ বিপন্ন লাগছে। মনে হচ্ছে, একজন খ্যাপাটে কমরেড বিদায় নিলেন।