দীপক চৌধুরী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই উল্লেখ করেছেন এ সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গ। ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছেন। নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার নবায়ন ও প্রচেষ্টা জোরদার করতে বলেছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে উচ্চপর্যায়ের এক ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনটি বিষয় তুলে ধরে তিনি এ আহ্বান জানান।
আমি বলতে চাই, রাজনীতিতে আমাদের দেশের নারীরা ভীষণভাবে এগিয়ে। শুধু সংখ্যা দিয়েই এ হিসেব করতে চাই না। বাস্তব চিত্র চোখের সামনে। এখন পৃথিবীতে উদাহরণ হয়েই আছে, এদেশে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, উপনেতা নারী, বিরোধীদলীয় নেতা অর্থাৎ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারী। দক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তোলার একের পর এক উদ্যোগ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। যা কখনো বাংলাদেশ ভাবতেই পারেনি, স্বপ্নেও দেখেনি।
তৃণমূলে প্রশাসনের অর্থাৎ উপজেলায় শীর্ষ পদে নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। দেশের ৪৯২টি উপজেলায় ৪৪৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মধ্যে ১৪০ জনই নারীকর্মকর্তা। জেলা প্রশাসক পদে আছেন দশজন নারী। আর প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে সচিব পদে আছেন এগারো নারী কর্মকর্তা। খাদ্য সচিব, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ভূমি আপিল বোর্ড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদসহ রাষ্ট্রের অনেক সর্বোচ্চ পদেও এখন নারীরা। যেমন- বেগম শামীমা নার্গিস, জুয়েনা আজিজ, কামরুন নাহার, বদরুন্নেছা, হোসনে আরা বেগম, কাজী রওশন আক্তার, উম্মুল হাছনা, ড. মোছাম্মাৎ নাজমানার বেগম, ফাতিমা ইয়াসমিন, বেগম সুলতানা আফরোজ, মোছা আছিয়া খাতুন প্রমুখ সিনিয়র সচিব বা সচিব পদে রয়েছেন। শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নারী কর্মকর্তারা কিন্তু কঠিন পরীক্ষা ও যোগ্যতার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন। অবশ্য কয়েকমাস আগের তথ্য এটা। তবে গর্বের সঙ্গে এটুকু বলা সম্ভব যে, সচিবালয়সহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী কর্মকর্তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব ৮৯ জন (পুরুষ ৪৩০), যুগ্ম সচিব ৮২ জন (পুরুষ ৫৫৬), উপসচিব ৩৫০ জন (পুরুষ ১৩৪০), সিনিয়র সহকারী সচিব ৪৪৮ জন (পুরুষ ১০৭০) ও সহকারী সচিব পদে প্রায় ৫০০ (পুরুষ ১১০০) নারী কর্মকর্তা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
বাংলাদেশের নারী পুলিশ নিয়ে গর্ব করার এক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাজনীতিবিদ কামাল পাশা চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালিত ডিআর কঙ্গোর ‘মনুস্কো’ বিমানবন্দর সুরক্ষার দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের নারী শান্তিরক্ষীরা। জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত এই বিমানবন্দরটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যার সুরক্ষা দেয়া একটি দুঃসাহসিক কাজ। রোটেশনের কমান্ডার মেরিনা আক্তারের নেতৃত্বে বিদেশ বিভূঁইয়ে সঙ্ঘাতময় দেশে বাংলাদেশ পুলিশের নারী শান্তিরক্ষীদের এই অভিযাত্রা কঙ্গোবাসীর মনে জাগিয়েছে নতুন আশা।’
খুব সম্ভবত ৮২ সালের আগে মেয়েরা বিসিএস পাস করলেও এডমিন ক্যাডারে আসতে পারতেন না। সেবারই প্রথম বিসিএসে মেয়েরা এডমিন ক্যাডারে এসেছেন। ২০২০-এ এসে আমরা যেনো দেখছি সর্বত্র নারীরা, তাদের দক্ষতা, বিনয় ও কর্মনিষ্ঠা । বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, নারীর ক্ষমতায়নে ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ আগ্রহী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এখন সেনাবাহিনী, বিজিবিতে নারীরা এগিয়ে আসছে। নারীরা এখন সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের প্রিন্সিপাল, সেনাকর্মকর্তা, র্যাব কর্মকর্তা, পুলিশের ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমন কি বিচারপতিও হচ্ছেন। সব ক্ষেত্রেই এগোচ্ছে এই ধারা। যা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, মেয়েরা পিছিয়ে থাকলে দেশও এগোতে পারবে না। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পরিবেশ ও নারীর ক্ষমতায়ন কেবল তার সদিচ্ছার কারণেই সম্ভব হচ্ছে।
নারী-শিশু নির্যাতনের একটি ঘটনা লিখতে গিয়ে লালমনিরহাট জেলার পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা গর্ব করেই ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাকে অবাক করে দিয়ে রিমা (নির্যাতনের শিকার হয়েছিল) বলল পুলিশ হতে চাই।’ আসলে পুলিশের আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও কর্মনিষ্ঠা রিমাকে বিশ্বাসী করে তুলেছে। কর্মরত পুলিশদের আচরণে মেয়েটি মুগ্ধ। পুলিশের প্রতি আস্থাবান হয়ে ওঠার মাধ্যমে রিমার স্বপ্নের যাদুকর হয়ে উঠেছে এ বাহিনীর সদস্য। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঠিক পদক্ষেপ বা তত্ত্বাবধানে অনেক ভুক্তভোগীও উপকার পেয়ে দারুণ মুগ্ধ হন। বাংলাদেশের বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদও নারীর ক্ষমতায়নে ভীষণ আগ্রহী। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কাজের ধারায়। তাঁর কর্মক্ষেত্রে নেওয়া অসংখ্য পদক্ষেপের এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে। সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি, অধীনস্থদের বিষয়ে ড. বেনজীর আহমেদ নারীর সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতে পারেন অতি সহজেই। তবে নারী পুলিশ কর্মকর্তার যোগ্যতা ও মেধাকে সবসময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তিনি। দেশকে যাতে অশুভশক্তি স্পর্শ করতে না পারে এ লক্ষ্যে জীবনপ্রাণ লড়াই করেছেন ও করছেন বেনজীর আহমেদ। নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে এটাও বলে রাখা দরকার যে, পুরুষ কর্মকর্তার সহযোগিতায়ই নারী কর্মকর্তার এগিয়ে চলা সহজ হয়ে থাকে।
সিনিয়র নারী কর্মকর্তাদের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে অন্যরাও। জেলা প্রশাসক হিসেবে একসঙ্গে এত নারী অতীতে কখনো কাজ করেননি। বাঙালি এমনিতেই রক্ষণশীল। আমাদের সমাজ এখনো পুরুষশাসিত। সমাজে নারীদের বাইরে কাজ করতেই বাধা দেয়া হতো । কোদাল দিয়ে নারী মাটি কাটবে, নারী কৃষিকাজ করবে, নারী দিনমজুরি করবে এটা ভাবনার বাইরে ছিল।
মেয়েদের স্বপ্ন দেখাতে পছন্দ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে আগের চেয়ে নারী কর্মকর্তাদের অনেকে ইউএনও, এডিসি, ডিসি হয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবেও কাজ করার সুযোগ হয়েছিল কবি শাহিদা সুলতানার। এখন তিনি গোপালগঞ্জে জেলা প্রশাসক। তিনি চমৎকার কবিতা লিখেন। এই নারী কর্মকর্তা ডিসি হওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এ মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানালেন, ‘মাঠ প্রশাসনে একবার যারা ভাল করতে পারেন তারা আলোচনায় থাকেন। সেসব নারী কর্মকর্তাদের পদায়নের চেষ্টা করি আমরাও।’
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে ওই ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই বলেন, প্রতিটি মেয়ের কাছ থেকে বিশ্ব উপকৃত হতে পারে, যার সম্ভাবনা ইতোমধ্যে উপলব্ধি করা গেছে, প্রতিটি নারী যাদের মেধা অবিকশিত এবং শুধু শিক্ষার মাধ্যমেই এর বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘আয় এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই ক্ষমতায়ন সৃষ্টি হয়। তাই আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু ডিকেড অব অ্যাকশনে প্রবেশ করেছি, তাই আমাদেরকে অবশ্যই প্রতিশ্রুতি নবায়ন করতে হবে এবং নারী-পুরুষের সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে আমাদের প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে।’ জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ে নারী প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা সব পর্যায়েই এমনটা দেখতে চাই। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অসামান্য উন্নয়নের কথা এখন বিশ্বে আলোচিত হয়ে থাকে। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের নারীরা বাধা ভাঙছেন এবং পেশায় সফল হচ্ছেন, যা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কখনোই কল্পনা করতে পারত না।’ তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স অনুসারে, আমরা নারীদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছি। ১৪৯টি দেশের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পঞ্চম স্থানে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ৭ম স্থানে রয়েছে। আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে।’
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক