মারুফ রসূল: সেক্টর কমান্ডাররা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। গত ২৫ আগস্ট জীবনাবসান ঘটলো চার নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্তের; আজ চলে গেলেন আট নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী। ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ১৫ আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত। পরবর্তীতে (১৮ আগস্ট ১৯৭১ - ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) এই সেক্টরের দায়িত্বে আসেন মেজর এম আবুল মঞ্জুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ছিলেন ইপিআরের চার নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর ৪ নম্বর উইংয়ের দপ্তরে চলে যান আবু ওসমান চৌধুরী। সেখানে গিয়ে এলাকায় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে কুষ্টিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। আক্রমণের দিনক্ষণ ঠিক হবার পর শুরু হয় সেনাবাহিনীর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য গঠন করা হয় উপদেষ্টা পরিষদ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আসহাবুল হককে করা হয় বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান আর আবু ওসমান চৌধুরীকে সামরিক বাহিনীর প্রধান।
৩০ মার্চ ভোরে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণ করেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। পরাজিত জীবিত পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইন ও ওয়্যারলেস স্টেশন ছেড়ে জিলা স্কুলে একত্র হওয়ার চেষ্টা করে। ৩১ মার্চ ভোরে আবার কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে অবস্থান করা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়; কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের গোলা বর্ষণে তাদের সম্পূর্ণধ্বংস করা যায়নি। দিনের যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকা অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা ওই রাতে দুটি জিপ ও দুটি ডজ গাড়িতে করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে। ৩০ ও ৩১ মার্চের সেই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় মুক্ত হয় কুষ্টিয়া। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পথ তৈরি হয়। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে আবু ওসমান চৌধুরী এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার দেন।
স্বাধীন দেশে তিনি লেফটেনেন্ট কর্নেল হিশেবে পদোন্নতি পান। বঙ্গবন্ধু তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনা সদস্যরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ি না থাকায় তিনি বেঁচে গেলেও সেদিন নিহত হয়েছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী নাজিয়া খানম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি সোচ্চার থেকেছেন। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যানের পদেও ছিলেন। একে একে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ক্রমাগত এক অনিঃশেষ শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কতোটুকু সংরক্ষণ করতে পারছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য? তাঁদের প্রবাদপ্রতিম জীবনের কতোখানি আমরা তুলে দিতে পারবো অনাগত প্রজন্মের হাতে? বিদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তথ্যসূত্র: [১] বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। [২] বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম