আনিসুল হক: আশা করি, আপনারা বোঝেন, টাকার জন্য আমরা কেউ লিখি না। আমাদের বড় দুই চন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র এবং নীরদচন্দ্র নিষেধ করে গেছেন। বঙ্কিমবাবু বলেছেন, টাকার জন্য লিখিবে না। আর নীরদ সি চৌধুরী বলেছেন, লেখক দুই প্রকার। ছাগল লেখক এবং পাগল লেখক। ছাগল লেখক লেখে টাকার জন্য। আপনাদের ভেতরের খবরটা দিই। একটা বইয়ের দাম একশ টাকা হলে লেখক প্রতি কপিতে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা পাবেন। এক হাজার বই বিক্রি করতে জীবন বের হয়ে যায়। এক হাজার কপি বিক্রি হলে লেখক পান দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। এক হাজার কপি বিক্রি করতে হলে কাগজে চল্লিশ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন দিতে হয়, ফেসবুকে চল্লিশবার স্টাটাস দিতে হয়, আর বইমেলায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসিমুখে মানুষের সঙ্গে সেলফি তুলতে হয়। এই সময়টা রিকশা চালালে দেড় লক্ষ টাকা আয় করা যাবে। তারপরও কেন লেখক লেখেন? কেন তার বই বিক্রি হলে খুশি হন (কেউ কেউ প্রকাশ্যে খুশি হন, কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলেন, বিক্রি হলো নাকি, ছি ছি, আমি কি পপুলার লেখক হয়ে যাচ্ছি, হায় হায় আমার বই বিক্রি হওয়া তো ভালো লক্ষণ নয়)? কারণ লেখক তার ভেতরের একটা কথা, একটা শিল্পবাসনা, একটা সৌন্দর্যবোধ অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য লেখেন। কেউ যখন দাম দিয়ে সেটা সংগ্রহ করে, আশা করা যায়, জিনিসটা অপাত্রে যাবে না।
তিনি এপ্রিশিয়েট করতে পারবেন। শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী আমাকে উৎসাহ দেন। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তিনি বলেছেন, শিল্পী লেখকরা যদি নিজের প্রিয়তর কাজটা করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, সেটাকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসার চোখে দেখেন। মানে ধরা যাক, একজন পেইন্টার ছবি এঁকেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, জীবিকা নির্বাহ করতে পারলেন। কিন্তু সেটা করা বেশ কঠিন। আর অলাভজনকও। আমাদের এক প্রকৌশলী হালদার কতো হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেলো, দেখলেন তো। আমি যখন রেলের চাকরিটা ছেড়ে দিই, তখন এক রসিক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে রসিকতা করে বলেছিলেন, গোটা দুই রেলগাড়ি বিক্রি করে বালিশে ভরে টাকা নিয়ে এসেছ তো? ডলার করে বিদেশে পাঠিয়ে দাও। আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, উপন্যাস লেখা মানে নিজের রক্ত ঢেলে দেওয়া, প্রতিটা অক্ষরের সঙ্গে লেখকের এক ফোঁটা করে রক্ত যায়। তারপরেও লেখক লেখেন। কারণ না লিখে তিনি পারেন না। শিল্পী ছবি আঁকেন, কারণ না এঁকে তিনি পারেন না। এরা আসলে পাগল। ফেসবুক থেকে