শাহীন চৌধুরী: এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পরিবহন যোগাযোগ, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বিকাশে বিমস্টেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন এর মহাসচিব এম শহিদুল ইসলাম। আমাদের অর্থনীতি ও আমাদের নতুন সময়ের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, অধিকাংশ সদস্য দেশ বিমস্টেক ট্রান্সপোর্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচার এন্ড লজিস্টিক স্টাডি ২০১৪-এর অধীনে ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে, তা পূরণ হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই অঞ্চলে সার্ক ও আসিয়ান কার্যকর থাকা অবস্থায়ও ১৯৯৭ সালে ব্যাংকক ডিক্লারেশনের মাধ্যমে বিমস্টেক প্রতিষ্ঠিত হয় মূলতঃ অধিকতর অর্থনৈতিক, কারিগরি ও যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমে ৪টি দেশ এর সদস্য হয়। দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ. ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। পরবর্তীতে মিয়ানমার এবং সবশেষে নেপাল ও ভূটান বিমস্টেকের সদস্য দেশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়। তিনি বলেন, আঞ্চলিক এই সংগঠনটি গঠিত হওয়ায় এই এলাকার বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্য ও পরিবহন যোগাযোগ, কারিগরি সহযোগিতা, দূর্যোগ মোকাবেলা ব্যাবস্থাপনা, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে বিমস্টেক অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, সদস্য দেশগুলো বিমস্টেক এর সহযোগিতার ১৪টি সেক্টর চিহ্নিত করেছে যা কোন একটি দেশের পক্ষে এককভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন, কিন্তু ঐক্যবদ্ধভাবে বাস্তবায়ন করা সহজতর।
মহাসচিব বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই বঙ্গোপসাগর বিশ্ব ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৫%, যা বৈশ্বিক গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারের অনেক উর্ধে। সাতটি দেশ ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তাদের মধ্যে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বিমস্টেকের ৭টি দেশের মধ্যে সার্কভুক্ত দেশ ৫টি আর আসিয়ান ভুক্ত দেশ ২টি। ফলে সার্ক এবং আসিয়ানের মধ্যেও বিমস্টেক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপনকারি বাণিজ্যিক রুট হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। তাছাড়া এ অঞ্চলের অধিকাংশ নদী হিমালয় থেকে নেমে এসেছে এবং যার ফলে ”আসমূদ্র হিমাচল” ভিত্তিক একটি পরিবেশ ও প্রতিবেশ বলয় নির্মিত হয়েছে। তিনি বলেন, এই সংস্থার অধিকাংশ দেশ উপকুলীয় হওয়ায় এই অঞ্চলের বড় সমস্যা সাইক্লোন এবং জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্লাইমেট চেঞ্জের কারনে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। তবে বিমস্টেক দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে এ সব সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিমস্টেক মহাসচিব বলেন, এ পর্যন্ত বিমস্টেকের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অংশগ্রহনে ৪টি সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সামিট ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের মিটিংগুলো নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে । আগামী ১০ ও ১১ অক্টোবর কলম্বোতে পরবর্তী স্থায়ী ওয়ার্কিং কমিটি মিটিং অনুষ্ঠিত হবে । এই মিটিংএ বিমস্টেক এর চার্টার নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে। তিনি বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতার বিভিন্ন ধাপ, বিশেষ করে প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (এফটিএ) কার্যকর হওয়া জরুরী। এ ছাড়া পণ্য, সেবা, পুঁজির অবাধ যাতায়াত নিশ্চত করার লক্ষ্যে এফটিএ সংক্রান্ত চুক্তিগুলো অচিরেই চূড়ান্ত করার জন্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভিসামুক্ত যাতায়াত বা অভিন্ন মুদ্রার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব বলেন, প্রথম পর্যায়ে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণ এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে বাণিজ্য ও পর্যটন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী মাল্টিপোল ভিসা এবং পর্যটকদের জন্যে অন-এরাইভাল ভিসার বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হবে। এ ব্যাপারে ভিসা সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের পরবর্তী বৈঠক কলম্বোতে অনুষ্ঠিত হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এম শহিদুল ইসলাম বলেন, বিমস্টেক সচিবালয়কে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এর পরিচালক সংখ্যা ৩ থেকে ৭-এ উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। বর্তমানে বিমস্টেকের ৫ জন পরিচালক রয়েছেন। ২০২০ সালে শ্রীলংকা থেকে একজন এবং ২০২১ সালে থাইল্যান্ড থেকে আরও একজন পরিচালক যোগদান করবেন। তিনি বলেন, ঢাকায় বিমস্টেক সচিবালয়ে বর্তমানে ২৫ জনের মত স্টাফ কর্মরত আছেন। বিমস্টেক সদর দফতরের কলেবর বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বিমস্টেক সদর দফতরের জন্যে একটি সুপরিসর ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহন করেছে। সচিবালয়ের খরচের মধ্যে ভারত ৩২%, থাইল্যান্ড ১৭.২৫%, বাংলাদেশ ১৪.৫% শ্রীলংকা ১৩.৭৫%, মিয়ানমার ৯%, নেপাল ৭.৫% এবং ভূটান ৬% প্রদান করে থাকে।
বিমস্টেক মহাসচিব বলেন, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে জনস্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে বিমস্টেক। তিনি বলেন, সম্প্রতি বিমস্টেক আয়ুরবেদিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থান এবং প্রাথমিক বাজেট অনুমোদন প্রক্রিয়ারও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এম শহীদুল ইসলাম বলেন, কাউন্টার টেররিজম, ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, মাদক এবং মানব পাঁচার ইত্যাদি এই অঞ্চলের একটি গুরুতর সমস্যা। এসব বিষয় নিয়েও সদস্য দেশগুলো একযোগে কাজ করে চলেছে। তিনি বলেন, যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিমস্টেক অব্যাহতভাবে কাজ করছে, তাতে করে খুব শিগগিরই এটি একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে।