মেরাজ মেভিজ : অবসায়ন হলে ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু সম্প্রতি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) অবসায়ন ঘোষণার কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা যায় আমানতের অর্ধেক সম্পদও নেই প্রতিষ্ঠানটির। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও পিপলসের মূলধন হঠাৎ উধাওয়ে বিস্মিত। এদিকে আইনের এই ফাঁক গলে ইচ্ছেকৃত অবসায়নের পথে হাঁটছে আরও তিন প্রতিষ্ঠান।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুরবস্থায় শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিকে (বিআইএফসি) অবসায়নের জন্য মতামত চেয়ে এরইমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিআইএফসি ছাড়াও রেড জোনে থাকা ১২ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডও হাঁটছে অবসায়নের পথে। রেড জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরাও।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আসলে এখন সময় হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব অনিয়মের ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগের। আমার মনেহয় এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে দুদকেরও সাহায্য নিতে পারে। যারা ইচ্ছেকৃত অবসায়নের কথা ভাবছে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে ভবিষ্যতে এমন অপরাধ করার আগে তারা দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবেন। কারণ পরিচালকরাই কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের সবচেয়ে বড় হোতা। তাদের আইনের আওতায় আনাটা জরুরি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। ঘাটতি ৭৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদে পরিবর্তন এনেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।
অন্যদিকে, পরিচালককে দেয়া ঋণের অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনিয়ম, লাগামহীন খেলাপি ঋণ এবং অর্থ সংকটে থাকা ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অবস্থাও সংকটাপন্ন। এমনকি আমানতকারীদের অর্থও ফেরত দিতে পারছে তারা। খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ প্রতিষ্ঠানটি এতটাই সংকটে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) মতো টাকা নেই। পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের উন্নতি হয়নি। মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতায় প্রতিষ্ঠানটির ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা, যা পূরণের সক্ষমতা না থাকায় বিশেষ বিবেচনায় পাঁচ বছর সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতটা না হলেও, নানা সংকটের কারণে সমস্যায় পড়েছে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডও। প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। আর মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
আরো নয়টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ রয়েছে দুই অঙ্কের ঘরে। এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এতই নাজুক যে, তারা গ্রাহকের ‘এফডিআরের’(আমানত) টাকা পর্যন্ত ফেরত দিতে পারছে না। টাকা না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন অনেকে।
সম্প্রতি আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের যে হিসেব দিয়েছিল মাত্র তিন মাসের মধ্যেই তার থেকে উধাও হয়ে যায় ১ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। তাতে বর্তমানে তাদের সম্পদের চেয়ে আমানতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯৮ কোটি টাকা। সম্পাদনা: সুতীর্থ