মনজুর এ আজিজ : উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে দেশীয় গ্যাসফিল্ডগুলোর গ্যাসের উৎপাদন। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই রাষ্ট্রীয় কোম্পানির মালিকানাধীন ১৬টি গ্যাস ফিল্ডের ৭৩টি কূপ দিয়ে ৭৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৫ সালের ১৫ জুলাই গ্যাস পাওয়া গেছে ৭১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে কমেছে দেশের সামগ্রিক গ্যাস উৎপাদন। ক্রমান্নয়ে প্রতিদিনই কমে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এদিকে গত ২০ দিনের ব্যবধানে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন কমেছে ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। আর এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন কমেছে ৭ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট। বিবিয়ানার পাশাপাশি দেশীয় অন্যান্য গ্যাসফিল্ডগুলোতেও উল্লেখযোগ্য হারে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ তাদের বিবিয়ানা ফিল্ডে এক টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) এর কম মজুদ নিয়ে ৯১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে। একই দিনে অনেক বেশি মজুদ এবং সমান সংখ্যাক কূপ (২৬টি) দিয়ে তিতাস গ্যাসক্ষেত্র মাত্র ৩২৬ মিলিয়ন উৎপাদন করেছে। পেট্রোবাংলার ২০২৩ সালের ৩০ জুনের রিপোর্ট অনুযায়ী তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের মোট মজুদ বিবেচনা ধরা হয় ৮ টিসিএফ, এ যাবত ৫.২ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সেখানে অবশিষ্ট মজুদ রয়েছে প্রায় ৩ টিসিএফ গ্যাস। অন্যদিকে বিবিয়ানার অবশিষ্ট মজুদ বলা হয়েছে ১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। এরপর আরও এক বছর চলে গেছে, দৈনিক প্রায় ১ বিসিএফ করে গ্যাস উত্তোলন ধরা হলে ৩৬৫ দিনের উত্তোলন শেষে অবশিষ্ট মজুদ ৬০০ বিসিএফ থাকার কথা।
অন্যদিকে কয়েকগুন বেশি মজুদ (প্রায় ৩ টিসিএফ) নিয়েও তিতাস গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ উত্তোলন করতে সক্ষম। বিবিয়ানার তুলনায় রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডেও মজুদ বেশি, সেখানেও আশানূরূপ উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৬০ সালে আবিস্কার হওয়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের অবশিষ্ট মজুদ (প্রমানিত ও সম্ভাব্য মিলে) রয়েছে (জুন ২০২৩) ১.৭৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। রশিদপুরে গত ১৫ জুলাই গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৬১.৯ মিলিয়ন ঘনফুট। বিবিয়ানার তুলনায় প্রায় ৪ গুণ বেশি মজুদ রয়েছে কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্রে, উত্তোলন শেষে অবশিষ্ট মজুদ রয়েছে প্রায় ২ টিসিএফ। সেখান থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে মাত্র ৪৬.৭ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন নতুন কূপ খনন এবং পুরাতন কূপের ওয়ার্কওভার করেও ধ্বস ঠেকানো যাচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুদ কমে আসায় উৎপাদন কমে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই অবধারিত। গ্যাসের এ সঙ্কট সামাল দিতে প্রয়োজন ছিল তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আরও জোরদার করা। পাশাপাশি গভীর ও অগভীর সমূদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা। অথচ সেখানে গুরুত্বদিতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বিগত সরকারগুলো। সে কারণে দেশীয় উৎপাদন প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। সে কারণে আগামীতে দেশে গ্যাসের ভয়াবহ সংকটের শঙ্কা করছেন তারা।
সূত্রটি জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে নজর দিয়েছিল। আমদানির সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন থেকে বাড়াতে অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তারা। এরমধ্যে ছিল মহেশখালীতে তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, পায়রাতে ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন, সাতক্ষীরার ভোমরা-খুলনা পাইপলাইন এবং বেনাপোল-খুলনা পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে গ্যাস আমদানি, পাশাপাশি ভোলা-বরিশাল-খুলনা পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প। এরমধ্যে সামিট গ্রুপের সঙ্গে মহেশখালীতে ভাড়াভিত্তিক ভাসমান এলএনজি স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল এবং পায়রাতে ভাসমান টার্মিনালের জন্য মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি চুড়ান্ত ধাপে ছিল, পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পগুলোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। সবগুলো প্রকল্প ছিল বিশেষ বিধান আইনের আওতায়। অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে বিশেষ বিধান আইনের আওতাধীন এসব প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে বাড়ন্ত চাহিদার বিপরীতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি তো দূরের কথা, বর্তমান উৎপাদন অব্যাহত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসফিল্ডগুলোর মজুদ কমে যাওয়ায় বছরে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এক সময় দেশীয় উৎপাদন ২৮০০ মিলিয়নের উপরে পাওয়া গেলেও ১৫ জুলাই উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১৮২১ মিলিয়ন ঘনফুট। সে হিসেবে ঘাটতি হয়েছে ৯৭৯ মিলিয়ন ঘনফুট।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে দেশীয় উৎপাদনের ৫০ শতাংশ যোগান দেওয়া ফিল্ডটি থেকে এক সময় ১৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হলেও ১৫ জুলাই পাওয়া গেছে মাত্র ৯১৮ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলা তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৩০ জুনের রিপোর্ট অনুযায়ী গ্যাসফিল্ডটিতে অবশিষ্ট মজুদ ছিল প্রায় ১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। এরপর চলে গেছে আরও একটি বছর, দৈনিক প্রায় ১ বিসিএফ করে গ্যাস উত্তোলন ধরা হলে ৩৬৫ দিনের উত্তোলন শেষে অবশিষ্ট মজুদ ৬০০ বিসিএফ থাকার কথা। কিন্তু এখানে সরল অংক চলে না। হঠাৎ করেই বড়ধরণের ধ্বংস দেখা দিতে পারে। খোদ পেট্রোবাংলার অনেকেই মনে করেন, ২০২৬ সালের শেষ দিকে বিবিয়ানার উৎপাদন ৫০০ মিলিয়নের নিচে নেমে আসতে পারে। শঙ্কা সত্যি হলে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ১৫০০ মিলিয়নে নেমে এসে মারাত্নক গ্যাস সঙ্কটের সৃস্টি হতে পারে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে গ্যাসের চাহিদা ৪৫০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। যখন এক-তৃতীয়াংশ আমদানি করতে ত্রাহী অবস্থা, তাছাড়া দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ ফুরিয়ে আসছে, এতে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন। সে কারণে গ্যাস সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সূফী গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন কমছে, গ্যাস চাপ কমে যাওয়ায় কূপগুলোতে কমপ্রেসার ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যে কোন সময় বড় ধরণের ধ্বংস নেমে আসতে পারে। সেজন্য বিকল্প প্রস্তুতি রাখা দরকার। তাছাড়া ওই ঘাটতি সামাল দেওয়ার জন্য যেভাবে প্রস্তুতি থাকা দরকার সেখানে অনেক ঘাটতি দৃশ্যমান। আমদানি বাড়িয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। দু’টি ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে তাতে কোন অবস্থাতেই ১১০০ মিলিয়নের বেশি আমদানি সম্ভব নয়। আমদানি বাড়াতে হলে নতুন এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে।
ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনে কমপক্ষে ২৪ মাস, আর ল্যান্ডবেজড এলএলজি টার্মিনাল করা হয় তাহলে ৮০ মাসের ধাক্কা। শুধু টার্মিনাল হলেই সরবরাহ ইচ্ছেমতো বাড়ানোর সুযোগ নেই। আমদানির পরিমাণ ১৪০০ মিলিয়নের উপরে হলে গভীর সমুদ্র থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন পাইপলাইন বসাতে হবে। কিন্তু এসব কাজ এখন দৃশ্যমান নয়। সরকার চাইলেও এসব বিষয়ে বড় বিনিয়োগকারী পাওয়া অনেকটা চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে দরপত্র জমা না হওয়ায় আর ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছে না খোদ পেট্রোবাংলা।
তবে আশার কথা হচ্ছে-দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। চলমান ৫০ কূপের পাশাপাশি ১০০ কূপ খনন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ ৬৯টি আর ৩১টি পুরাতন কূপের ওয়ার্কওভার। ১০০ কূপ খনন প্রকল্প ২০২৬ সালে শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেখান থেকে ৭টি কূপ এগিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন ও অনুসন্ধান জোরদার করেছি। নতুন করে আরও দু’টি রিগ কেনা হচ্ছে। ফলে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে বলে আশার কথা জানান তিনি।