বিভুরঞ্জন সরকার: সঠিক দিন তারিখ মনে নেই। তবে ১৯৮৪-৮৫ সালের কোনো একদিন হবে। পুরানা পল্টনে কথাকলি প্রিন্টার্স ও সচিত্র সন্ধানী অফিসে গিয়েছে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আমাকে দেখে গাজী ভাই খুশি হলেন। এক চা খাওয়ার পরই বললেন, চলেন আপনাকে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে নিয়ে আসি। - কার সঙ্গে? আমি জানতে চাই। গাজী ভাই বলেন, আরে চলেন না!
ব্যস, বেরিয়ে পড়লাম দুজন। গাড়ি চলতে থাকলো এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। একটি গলির ভেতর ‘কনিকা’ নামের বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো গাজী ভাইয়ের গাড়ি। গাজী ভাই সোজা গিয়ে উঠলেন দোতলায়। পেছন পেছন আমি। দরোজা খোলাই ছিলো। একটি চেয়ারা বসে কিছু একটা পড়ছেন এক নারী। গাজী ভাই তাকে সালাম দিয়ে বললেন, খালাম্মা , এই যে বিভুকে নিয়ে এসেছি। খালাম্মা উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে আমি কার স্নেহের বাধনে বাধা পড়েছি। তার কতো গল্প গাজী ভাইয়ের কাছে শুনেছি।
শুনেছি তার গুণ ও সৌন্দর্যের প্রশংসা। তাকে একসময় ‘ঢাকার সুচিত্রা সেন’ বলেও অভিহিত করা হতো। তিনি আর কেউ নন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। একাত্তরের বীর শহীদ রুমীর মা। আমাদের অনেকের খালাম্মা। কারো কারো বা মা। যখন পরিচয় হলো তখন সচিত্র সন্ধানীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’। সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কতো দিন কতো বিষয়ে কথা হয়েছে। বিশেষ করে তার নেত্রীত্বে গণআদালত গঠন করে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের প্রতীকী বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার পর ‘যায়যায়দিন’- লেখার বিষয়েও তিনি আমাকে অনেক সময় পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি জানতেন, সম্পাদক শফিক রেহমান তার কার্যক্রম পছন্দ করেন না। সম্পাদকের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আমি গণআদালত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি খালাম্মার পরামর্শ ও প্রেরণায়। জাহানারা ইমাম বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃজাগ্রত করার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। পুত্র ও স্বামী হারানোর শোক এবং ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করেও তিনি বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সমস্ত বৈরিতা উপেক্ষা করে ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার এক গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তা তিনি সফলভাবেই পালন করেছেন। ২৬ জুন ছিলো খালাম্মার প্রয়াণ দিবস। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।