শিরোনাম
◈ মুগদায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় কিশোর নিহত ◈ বাংলাদেশ-চীন সামরিক মহড়া মে মাসে, নজর রাখবে ভারত ◈ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু: চুয়েটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, যান চলাচল শুরু ◈ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভারত, চীন বা রাশিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত নয়: মার্কিন কর্মকর্তা ◈ সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ২ ◈ থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ ◈ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় ◈ শিক্ষক নিয়োগ: ১৪ লাখ টাকায় চুক্তি, ঢাবি শিক্ষার্থীসহ গ্রেপ্তার ৫ ◈ বিদ্যুৎ-গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না ◈ নতুন করে আরও ৭২ ঘণ্টার তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি

প্রকাশিত : ১৮ জুন, ২০১৯, ০৬:৩৬ সকাল
আপডেট : ১৮ জুন, ২০১৯, ০৬:৩৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আমার বাবা, কবি বাবা

মৃত্তিকা গুণ : আমি দিদিমার কাছে বড় হয়েছি। বড় হওয়ার দিনগুলোতে সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে বাবাকে কাছে পেয়েছি তা নয়। তবে বাবাকে মাঝেমধ্যে খুব-খুউব করে কাছে পাওয়ার সুযোগ হয়েছে ভ্রমণে গিয়ে। বাবার সঙ্গে অনেক দেশে ঘুরেছি। কোথাও গেলে দর্শনীয় স্থানগুলোতে বাবা নিয়ে যেতে ভুল করেন না। কলকাতা গেলে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখিয়েছেন, সেগুলো সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন। তবে বাবা শিক্ষক হতে পারেননি কখনো।
কলকাতাতে যখন বাবার সঙ্গে গিয়েছি, দর্শনীয় স্থান যেগুলো আছে সেগুলোতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখিয়েছেন- দেখাতে দেখাতে ভিক্টোরিয়া সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন। বাবা যে স্থানগুলোতে নিয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বাবা নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। এভাবে বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু জানা হয়েছে। জানার উৎসাহ তিনি এভাবে দিয়েছেন। বাবা সব সময় মজার মজার গল্প করেন। প্রথমত তিনি জানেন, জানা থেকে বলেন এবং নিজস্ব মতামত যুক্ত করেন। বাবাকে দেখেছি যখনই কোনো দেশে যাবেন, সেই দেশ সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনী তিনি আগে পড়ে নেন। যখন জাপান গেলাম তখনো রবীন্দ্রনাথের বই বাবা সঙ্গে নিয়েছিলেন। বইটা পড়ে নিয়েছিলেন আগেই। তারপর বিভিন্ন জায়গায় যেতে যেতে শুনিয়েছেন জাপানিজদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন, সেদেশের রাজনীতি নিয়ে কী বলেছেন; এ ধরনের আর কি! নির্মলেন্দু গুণকে শুধু বাবা হিসেবে বিশ্লেষণ করতে গেলে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে। একজন পাঠক হিসেবে কবিকে যেভাবে উপভোগ করা যায় বাবা হিসেবে সেটা হয় না। অবশ্য বাবা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যরকম। অন্যান্য বাবা তাদের সন্তানদের যেভাবে ঢ়ধসঢ়বৎ করেন বাবা সেভাবে কখনোই করেননি। আমি ছোট-বড় কোনো কাজ করলাম আর বাবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন- এ রকম না। সহজে মুগ্ধ হন না, আবার যেটা ভালো মনে করেন সেটা ভালো বলেন, যেটা ভালো মনে করেন না সেটা বলে দেন- এটা ভালো হয় নাই।
সাধারণ বা অসাধারণ বাবা বলে তো কেউ নেই, সব বাবা অসাধারণ! তবে আমি আমার বন্ধুদের বাবাদের দেখেছি, সন্তানদের একেবারে কোলে নিয়ে-নিয়ে ঘুরছেন; ওটা বাবার মধ্যে কখনো ছিলো না। অবশ্য বাবার স্বভাবটা সেটা দাবিও করে না। সমাজে আট-দশজন বাবাকে আমরা আসলে কীরূপে দেখি? বাবারা চাকরি করেন বা নিয়মিত কোনো কাজ করছেন। আমার বাবা তো ফ্রিল্যান্সার। বাবা কোথাও চাকরিতে নিয়মিত হতে পারেননি। চেষ্টা করেছেন তবুও পারেননি। এই ধরনের ঝামেলা তো আছেই।
আমার বাবা-মা আলাদা থাকেন। আমি একটা সময় বাবার সঙ্গে থাকতে গিয়েছিলাম, মানে দিদিমার বাসায় থাকার আগে। তখন দেখেছি যে, বাসা ভাড়া নিয়ে বাবাকে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। ভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা। আসলে তার কাছে সেরকম টাকা ছিলো না। বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলো না। ফ্রিল্যান্সারদের যেটা হয়। নির্দিষ্ট আয় ছিলো না। আবার আয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে যে, বাবা সেভিংয়ে বিশ্বাস করেন না। বিপদ হলে কী হবে এ বিষয়ে তার কোনো চিন্তা বা ভয় নেই- অকুতোভয় টাইপের। ব্যাপারটা এরকম ‘বিপদ হলে হবে, তো কী হবে!’ এমনিতে বাবাকে কোনোদিন অভাবী মনে হতো না। যা টাকা পান বেশিরভাগ সময় চেষ্টা থাকে শেয়ার করার। মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে তিনি পছন্দ করেন। যেমন স্কুলে লাইব্রেরি করা, স্কুল করা এসব কাজ তিনি করেছেন। নিজের জমি স্কুলে দিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে ভাতা পান সেখান থেকে আমাদের স্কুলের টিচারদের তিনি টাকা দেন। এভাবে বলা যায়, বাবার সংসারটা অনেক বড়। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চান সেই সংসারে। বৃষ্টি বা রোদের মতো উপর থেকে ছড়িয়ে পরতে চান সবখানে। বাবাকে শখ করে নিজের জন্য কখনো কিছু কিনতে দেখিনি। উৎসব এলে নিজের জন্য পোশাক কিনবেন, এমন কখনো হয়নি। তবে আমাকে উপহার দিতে পছন্দ করেন।
আমি একবার জাপানে গিয়ে একটা ঐধহফুপধস কিনেছিলাম। সেটি সিএনজির পেছনে রেখেছিলাম। নামার সময় ফেলে চলে আসি। তারপর যেটা হলো, বাবা আরেকবার জাপান গেলেন। সেখানে বই বিক্রি করে কত টাকা পেয়েছিলেন জানি না। তবে ফেরার সময় মনে করে আমার জন্য একটি ঐধহফুপধস নিয়ে এসেছিলেন। সময়টা যতোদূর মনে পড়ে ঊনিশশ পঁচানব্বইয়ের দিকে।
বাবা বিদেশ গেলে আরেকটা কাজ করেন, আমাদের গ্রামের যে বাচ্চা ছেলেগুলো আছে তাদের জন্য চকলেট নিয়ে আসেন। আমাদের আত্মীয়-স্বজন অনেকেই বিদেশ থেকে দেশে আসেন, তারা কিন্তু এই বিষয়ে বাবার মতো নয়। আবার অন্য বাবাদের মতো আমার বাবার গল্পগুলোও এমন ছিলো না কখনো- মেয়ে বড় হবে, উচ্চশিক্ষিত হবে, বিয়ে হবে। এসব নিয়ে একদম কখনো কোনো কিছু বলতেন না, তিনি চেয়েছেন আমি স্বাধীনচেতা হই। কখনো হস্তক্ষেপ বা গাইড করেননি। তবে আমার মনে হয় গাইড করা ভালো। সন্তানদের তো একটু গাইড করতে হয়। বেশি স্বাধীনভাবে বড় হতে দিলে হয় কী, তার বেজটায় আর হাত দেয়া হয় না।
বাবা আমাকে কোনো কাজেও উৎসাহিত করেননি। আমি যতোটুকু লেখালেখি করেছি সেটা আমার মামা-দিদিমার উৎসাহে। তাদের উৎসাহে গল্প-কবিতা পড়েছি। বাবা কখনো বলেননি- এই বইটা পড়। তার চিন্তা হচ্ছে তোমার পড়ার ইচ্ছা হলে নিজেই পড়বে, এটা বলার কী আছে? দিদিমার বাসায় চলে আসার পর থেকে বাবা নিয়মিত দেখা করতে আসতেন। কিন্তু কোনো সকালে উঠে এমন দেখা হতো না- বাবা অফিসে যাচ্ছেন বা অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছেন; এই ধরনের লাইফ ছিলো না। আবার বাবার সঙ্গে আমার যে দেখা হওয়া, কথা হওয়া সেটাও কিন্তু মজার ছিলো। বাবা আমাকে কখনো স্কুলে নিয়ে যেতেন না। তবে নিয়মিত স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন। কোনোদিনও তিনি আমাকে আনতে যেতে দেরি করেননি। আমার বন্ধুদের নিতে আসতেন তাদের মায়েরা। যে কারণে বন্ধুদের মায়েরা আমার বাবাকে খুব ভালোভাবে চেনেন। স্কুল থেকে বাবা আমাকে দিদিমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতেন।
আসলে বাবা চেষ্টা করেছেন আমাকে একটু পড়ানোর বা শেখানোর। কিন্তু বাবা এটা পুরোপুরি পারেননি। কারণ এজন্য যতোটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিলো বাবার মধ্যে ততোটাই ছিলো কোমলতা। কঠিন ব্যাপারটাই তার মধ্যে কম আছে। আমার পুরো পড়াশোনা দিদু-দিদিমা লক্ষ্য রেখেছেন। তাদের কারণেই আমি এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছি। বাবা স্বশিক্ষিতি হওয়ার জায়গাটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাবার যে জীবন তাতে প্রথমতো আমার ভালো লাগা, না লাগায় কিছু আসে যায় না। আমি যদি একধরনের চিন্তা করি, তাহলে আমার মনে হয় যে, আট-দশজনের মতো করে বাবাকে পেয়ে বা সাধারণ জীবন পেয়ে আমার কী হতো! আমি তো একটা ভিন্ন জীবন পেয়েছি। এখন নিজেকে কতোটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছি সেটা হয়তো আমার যোগ্যতা বা অযোগ্যতা। কিন্তু আমার আশেপাশে অবশ্যই শেখার নতুনত্ব অনেক ছিল। যেমন বাবার সঙ্গে যখন হুমায়ূন আহমেদের বাসায় যেতাম অনেক অনেক গল্প শুনতাম। এই ধরনের মানুষের সঙ্গে অনেক মিশেছি- মেশার সুযোগ পেয়েছি। ভারতে যখন গিয়েছি সেখানে অনেক লেখককে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি যখন ছোট, মাত্র চারবছর বয়স তখন বাবার সঙ্গে গিয়ে সত্যজিৎ রায়কে দেখেছি। তার সঙ্গে আমার ছবিও আছে। এগুলো আসলে আমার কবি বাবা বলেই সম্ভব হয়েছে। না হলে হতো না। হয়তো আমি স্বাভাবিক-সাধারণ জীবন পাইনি কিন্তু আবার অনেক অসাধারণ কিছু পেয়েছি। এখানে ‘স্বাভাবিক’ আসলে কী- যা নিয়মিত ঘটছে তাকেই তো আমরা স্বাভাবিক বলি। এক্সপেরিয়েন্স চিন্তা করলে অনেক ইন্টারেস্টিং লাইফ আমার। চিন্তা করলে মনে হয় অনেক ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। যার অনেক কিছুই হয়েছে বাবার কারণে। আমার বাবার সব থেকে শক্তিশালী সত্তা হচ্ছে কবি সত্তা। কবিত্ব বাদ দিয়ে বাবা খুব বেশি বা একান্ত অর্থে বাবা হয়ে উঠেছেন বা হতে পেরেছেন তা নয়। আমি বলি, আমার বাবা, কবি বাবা। সূত্র- রাইজিংবিডি ডট কম। শ্রুতিলিখন: স্বরলিপি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়