চ্যানেল ২৪ এর প্রতিবেদন।। বাউন্ডুলে-ভোগবাদী-আরামপ্রিয় সন্তানকেই কেন সব সম্পত্তি লিখে দেয়া হয়, এই প্রশ্নটা শুধু ব্যক্তিগত সম্পত্তি বণ্টনের সঙ্গে জড়িত নয়, এটি সামাজিক মনস্তত্ত্ব, আইনি কাঠামো, ধর্মীয় বিধান ও অর্থশক্তির প্রভাবে তৈরি এক জটিল চর্চা- যা দীর্ঘ সময় ধরে মানব সমাজে হয়ে আসছে। যে ব্যক্তি হাজার কোটি টাকার মালিক, তিনিও একই কাজ করছেন, যেমনটা করেন ১০-২০ কোটি টাকার মালিক বা এক কোটি টাকার মালিক। যিনি পৈত্রিক সূত্রে হাজার বিঘা জমি বা অনেকগুলি দিঘির মালিক, কিংবা যিনি শুধুমাত্র ভিটামাটির মালিক, তিনিও একই কাজ করেন।
উচ্চবিত্ত পরিবারে প্রায়ই দেখা যায় বাবা-মা তাদের বিপুল সম্পদ শুধুমাত্র সন্তানকেই দিয়ে গেছেন। একে আপাতদৃষ্টিতে উত্তরাধিকারীদের বলিষ্ঠ করে দেয়া বলা যেতে পারে। তবে এই আচরণটি অনেক সময় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের, বিশেষত যোগ্য কিন্তু দুর্বল অবস্থায় থাকা ভাগ্নে-ভাইঝি বা সম্ভাবনাময়ী কাছের আত্মীয়দের বঞ্চিত করে।
এমন সংকীর্ণ আচরণের পেছনে লুকিয়ে থাকে একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ (শুধুমাত্র সন্তানকে পুরস্কৃত করার প্রবণতা),সামাজিক মর্যাদা ও উত্তরাধিকারের মাধ্যমে নাম জারি রাখার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা কেন্দ্রীয়করণ (সম্পদের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখা) এবং পারিবারিক কুলীনতাবাদ বজায় রাখার মনস্তত্ত্ব।
অনেক সময় দেখা যায়, এই অঢেল সম্পদ দিয়ে বখাটে-অবাধ্য সন্তান আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। সে তখন মনে করে মাদক,হিংস্রতা ও বেপরোয়া আচরণের মাধ্যমে সে স্মার্ট হয়ে উঠেছে। আর তার চাচা-মামাতো-খালাতো ভাই-বোনেরা যারা সন্ধ্যার পরপরই ঘরে ফিরে, পড়াশুনা করে তারা অতীত আমলের মানুষের মতো বেড়ে উঠছে। এই ধরনের বেপরোয়া আত্ম-অহমিকা দ্রুতই পরিবারের ভেতরে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ককে তছনছ করে দেয় এবং কখনও কখনও এমন সব ছেলে-মেয়ে ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে ন্যাক্কারজনক উদাহরণ হয়ে থাকবে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার কিশোরী মেয়ে যে নিজের বাবা-মাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর কুপিয়ে হত্যা করে।
দেখা গেছে, মেধাবীদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েট, মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগরসব বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অনেক শিক্ষার্থী মাসে মাত্র কয়েক হাজার টাকা দিয়ে জীবন চালিয়ে করে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন দেশসেরা নাগরিক। অন্যদিকে, বিত্তশালীদের সন্তানেরা প্রতিদিন কয়েক হাজার এমনটি লাখ টাকা অপচয় করছেন শুধুমাত্র বিলাসিতার নামে। তারা অনেক সময় জড়িয়ে পড়ছেন মাদকসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাবিবুর রহমান চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, ‘পবিত্র কুরআনে বিপুল বিত্তশালী মানুষদের প্রতি সম্পদ হস্তান্তর ইস্যুতে অসিয়তের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উচ্চবিত্তের মানুষের সন্তানের যদি সম্পদ ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা না থাকে সেক্ষেত্রে অসিয়ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন সম্পদ দান-উপহার রূপে প্রদান করতে হয় যাদের প্রতি সেই বিত্তশালী কোন না কোনভাবে কৃতজ্ঞ। এ অবস্থায় বিত্তশালী যদি উইল বা অসিয়ত করে উত্তরাধিকার ছাড়া অন্য কাউকে সম্পদ দিয়ে যান সেক্ষেত্রে তার মৃত্যুর পর প্রথমেই তার সম্পদ থেকে অসিয়তের অংশ আলাদা করে উল্লেখিত ব্যক্তিকে দিয়ে দিতে হবে। স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা যদি আদায় না করা হয়ে থাকে তাও তার সম্পদ থেকে দিয়ে দিতে হবে। এরপর সন্তান-স্ত্রী এমনটি তার বাবা-মা যদি জীবিত থাকেন তবে সবার মাঝে উত্তরাধিকার আইন মেনে অবশিষ্ট সম্পদ যথাযথভাবে বণ্টন করতে হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, ‘মানুষসহ প্রতিটি প্রাণী নিজ প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব বেশি স্বার্থপরভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়। প্রতিটি মানুষই বাবা-মা হিসেবে চান তার-সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
শুধু তাই নয়, যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান, তাদের মনের গভীরে সবসময় একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে যে, তারা যা কিছু কামিয়েছে তা বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল, অথবা ধরা পড়ে গেল। তাই, তারা সেই সব অবৈধ সম্পদ নিজের একান্ত আপন উত্তরাধিকারদের মাঝেই কুক্ষিগত করে রাখতে চান, যারা তার অপকর্ম প্রকাশ করবে না বরং তা উপভোগ করবে। প্রবাদ আছে, এক প্রজন্ম সম্পদ অর্জন করে, পরের প্রজন্ম ভোগ করে এবং তার পরের প্রজন্ম তা হারিয়ে ফেলে। যে প্রজন্ম জন্মসূত্রে অঢেল সম্পদের মালিক হয়, সেই প্রজন্মের কাউকে খুব কমই পরিশ্রমী ও উদ্যোমী হতে দেখা যায়। কারণ, প্রাচুর্য এবং চাওয়ার আগেই পাওয়ার অভ্যাস তাদেরকে কর্মবিমুখ ও অলস স্বভাবের করে দেয়।’
মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এতকিছুর পরও আমরা দাতা হাতেম তাঈ বা হাজী মোহাম্মদ মহসিনের মত বিশাল হৃদয়ের দানশীল ব্যক্তিদের সমাজে খুঁজে পাই না যে, তা কিন্তু নয়। সার্বজনীন পরোপকারিতা (Altruism) মানুষের একটি বিরল ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, যা গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকে তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও বংশগতির যৌথ মিথস্ক্রিয়ার ফলে।
আধুনিক ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের (positive psychology) গবেষণার ফলাফলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, অভাবগ্রস্ত-বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবা বা উপকার করার মাঝেই প্রকৃত ও টেকসই সুখ লাভ করা যায়। সেই সঙ্গে পার্থিব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যা মানুষকে শুধু ভোগবাদিতা এবং আরাম-আয়েশ দিতে পারে না। তাই, সব ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষাও আমাদেরকে ত্যাগী, দানশীল এবং দয়ালু হতে শেখায়।
পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের অবচেতন দায়িত্ববোধ থেকে মানুষ নিঃস্বার্থ-পক্ষপাতহীন না হয়ে তার সন্তানের প্রতি অন্ধের মত পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে বাধ্য হন।’
সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী আরও বলেন, ‘এই দেশে উইল করে সম্পদ হস্তান্তরের রীতি খুব একটা দেখা যায় না। অধিকাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত নব্য বিত্তবানরা তাদের উত্তরাধিকারীদেরই সম্পদের মাধ্যমে শক্তিশালী করে দিতে নিরাপদ মনে করেন। তবে কিছু বিত্তশালী ব্যক্তি যাদের মধ্যে সুশিক্ষা এবং মননশীলতার প্রভাব রয়েছে তাদের মধ্যে ব্যক্তিক্রমী প্রবণতা দেখা যায়। তারা নিজের সম্পদ শুধুমাত্র উত্তরাধিকার আইন মেনে বণ্টন করেন না। তারা নিজের প্রজ্ঞা এবং বিবেচনা ব্যবহার করে নিজস্ব সম্পদ বণ্টন করে থাকেন। এই ধরনের নৈতিকবোধ সম্পন্ন ব্যাক্তি নিজের অযোগ্য-অথর্ব-লম্পট সন্তানকে বিপুল সম্পদের মালিক করে দিতে চান না। যাতে পরবর্তীতে সেই সব বিপথগামী সন্তানের বড় ধরনের অপরাধ করার শক্তি বেড়ে না যায়।’
বাংলাদেশে উত্তরাধিকার বা সাকসেশন আইন সম্পর্কিত একটি সাধারণ কাঠামো রয়েছে। সাধারণত সাকসেশন অ্যাক্ট- ১৯২৫ অনুযায়ী মানুষের উত্তরাধিকার ব্যবস্থাপনা করা হয়। তবে, ব্যক্তি যেহেতু ধর্মভিত্তিক, তাই ইসলাম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম অনুযায়ী আলাদা আলাদা নিয়মও মানা হয়।
ইসলামিক আইন অনুযায়ী, ইসলামে উত্তরাধিকার নিয়ে কুরআনে স্পষ্টভাবে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো সূরা আন-নিসা-যেখানে ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পদ ভাগ করার নিয়ম বলা হয়েছে। কুরআনে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই একটি নির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া, মুসলিমদের জন্য একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো উইল বা অসিয়াত। কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, একজন মুসলিম তার মৃত্যুর আগে সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ উইল করতে পারেন, এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। তবে, যদি কেউ এক-তৃতীয়ংশের বেশি সম্পদ উইল বা দান করতে চান, তাহলে সে জন্য তাকে উত্তরাধিকারীদের সম্মতি নিতে হবে।
হিন্দুদের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে পারিবারিক আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধি অনুসারে উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়। হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনগত সিদ্ধান্ত এবং মামলার মাধ্যমে নতুন দিকনির্দেশনা এসেছে। ইসলামী ও হিন্দু আইনে একে অপরের থেকে আলাদা নিয়ম রয়েছে, তবে উভয় ধর্মেই সঠিক ও ন্যায্য উত্তরাধিকার বন্টনের জন্য পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।