দুপুরের খাবার শেষ করার পরই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, কাজে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং শরীর জুড়ে একধরনের আলস্য ভর করে—এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সকলেরই। অনেকেই এই তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবকে শারীরিক দুর্বলতা বা কোনো রোগের লক্ষণ বলে মনে করেন। তবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আশ্বস্ত করছেন যে, এটি কোনো গুরুতর রোগ নয়, বরং আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। এই বিষয়টি আমাদের দেহঘড়ি (Circadian Rhythm) এবং হজম প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: পোস্ট-প্র্যান্ডিয়াল সোমনোলেন্স
বিজ্ঞানের ভাষায় দুপুরে খাওয়ার পর এই ঘুম ঘুম ভাবকে বলা হয় "পোস্ট-প্র্যান্ডিয়াল সোমনোলেন্স" (Postprandial Somnolence), যার সহজ অর্থ হলো—খাওয়ার পর তন্দ্রাচ্ছন্নতা। সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটি মূলত শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে খাদ্যাভ্যাস, ঘুমের অনিয়ম এবং জীবনযাত্রার ধরনের ওপর নির্ভর করে এর তীব্রতা কমবেশি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে একাধিক কারণ একসঙ্গে কাজ করে। প্রধান কারণগুলো নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. হজম প্রক্রিয়া ও রক্ত সঞ্চালন:
খাবার খাওয়ার পর আমাদের শরীর সেই খাবারকে ভেঙে শক্তিতে রূপান্তর করার জন্য পুরোদমে কাজ শুরু করে। এই হজম প্রক্রিয়ার জন্য পরিপাকতন্ত্রে প্রচুর পরিমাণে রক্তের প্রয়োজন হয়। ফলে মস্তিষ্কসহ শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে রক্তপ্রবাহ সাময়িকভাবে পেটের দিকে ধাবিত হয়। মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেনের সরবরাহ সামান্য কমে যাওয়ায় আমাদের শরীর কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ঘুম ঘুম ভাব তৈরি হয়।
২. হরমোনের খেলা:
খাবারের পর ঘুম পাওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে কিছু হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার।
কার্বোহাইড্রেট ও ইনসুলিন: আমরা যখন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার (যেমন: ভাত, আলু, রুটি, পাস্তা বা মিষ্টি) খাই, তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। এই গ্লুকোজকে কোষে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন হরমোন নিঃসৃত হয়।
ট্রিপটোফ্যান ও সেরোটোনিন: ইনসুলিনের অন্যতম একটি কাজ হলো রক্ত থেকে বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিডকে কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করা। তবে এটি ট্রিপটোফ্যান নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিডকে রক্তে ছেড়ে দেয়। এই ট্রিপটোফ্যান খুব সহজেই মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সেরোটোনিন-এ রূপান্তরিত হয়। সেরোটোনিন আমাদের মনকে শান্ত করে এবং ঘুমের অনুভূতি তৈরি করে।
সেরোটোনিন থেকে মেলাটোনিন: সেরোটোনিন পরবর্তীকালে মেলাটোনিন হরমোনে রূপান্তরিত হয়, যা আমাদের ঘুম চক্রকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। একারণে উচ্চ প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়ার পর ঘুম ভাব আসা খুবই স্বাভাবিক।
৩. দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদম:
আমাদের প্রত্যেকের শরীর একটি অভ্যন্তরীণ ঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদম দ্বারা পরিচালিত হয়। এই দেহঘড়ির নিয়ম অনুযায়ী, দুপুর ২টা থেকে ৪টার মধ্যে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা সামান্য কমে যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই কর্মশক্তি কিছুটা হ্রাস পায়। এই সময়টাকে বলা হয় "পোস্ট-লানচ ডিপ" (Post-lunch Dip)। তাই আপনি যদি দুপুরে নাও খান, তাহলেও এই সময়ে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। আর ভারী খাবার খেলে এই অনুভূতি আরও তীব্র হয়।
দুপুরের পর অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব আপনার দৈনন্দিন কাজে বাধা সৃষ্টি করলে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে পারেন:
সুষম খাবার গ্রহণ করুন: দুপুরের খাবার যতটা সম্ভব হালকা রাখুন। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। খাবারের তালিকায় ফাইবার, প্রোটিন এবং কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট (যেমন: লাল চাল, ডাল, শাকসবজি) যোগ করুন।
অল্প পরিমাণে খান: একবারে বেশি না খেয়ে, অল্প পরিমাণে ভাগ করে খেতে পারেন। এতে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বাড়ে না।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন: ডিহাইড্রেশন বা পানির অভাবেও শরীর ক্লান্ত হতে পারে। তাই সারাদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
হালকা শারীরিক পরিশ্রম: খাওয়ার পর ১০-১৫ মিনিট হালকা হাঁটাহাঁটি করলে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে এবং হজমে সাহায্য হয়। এতে আলস্য কেটে যায়।
পাওয়ার ন্যাপ নিতে পারেন: যদি সম্ভব হয়, ২০-২৫ মিনিটের একটি ছোট্ট ঘুম বা "পাওয়ার ন্যাপ" আপনাকে বাকি দিনের জন্য সতেজ করে তুলতে পারে। তবে এর চেয়ে বেশি সময় ঘুমালে গভীর ঘুমে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা ঘুম থেকে ওঠার পর আপনাকে আরও ক্লান্ত করে তুলতে পারে।
সাধারণত দুপুরের পর ঘুম পাওয়া স্বাভাবিক হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি অন্য রোগের ইঙ্গিত হতে পারে। যদি আপনার তন্দ্রাচ্ছন্নতা খুব তীব্র হয় এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন:
প্রতিদিন খাওয়ার পর অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা।
ঘুমের পরিমাণ ঠিক থাকা সত্ত্বেও সারাদিন ক্লান্ত থাকা।
হজমে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা বা গ্যাস-অম্বলের প্রবণতা।
মাথা ঘোরা বা চোখে ঝাপসা দেখার মতো উপসর্গ থাকলে।
এগুলো ডায়াবেটিস, অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা), স্লিপ অ্যাপনিয়া বা থাইরয়েডের সমস্যার মতো রোগের লক্ষণ হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, দুপুরের খাবারের পর সামান্য ঝিমুনি বা তন্দ্রাচ্ছন্নতা কোনো রোগ নয়, বরং এটি শরীরের একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। সুষম খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে এই প্রবণতাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে সমস্যা তীব্র হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ও গবেষণা প্রতিবেদন।