আজকাল ডায়াবেটিস একটি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এখন ঘরে ঘরে দেখা যায়। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার নানা দিক—যেমন অপরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ এবং অপর্যাপ্ত ঘুম—এই রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অনেক সময় দিনের বেলায় ডায়াবেটিসের কোনো স্পষ্ট লক্ষণ বোঝা যায় না। কিন্তু আমাদের শরীর ঘুমের মতো শান্ত সময়েও কিছু সূক্ষ্ম সংকেত পাঠায়, যা প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক সতর্কবার্তা হতে পারে। এই সংকেতগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ অনেক সহজ হয়ে যায়। চলুন, ঘুমের মধ্যে 나타나는 সেইসব লক্ষণ ও তার পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।
১. পর্যাপ্ত ঘুমের পরও তীব্র ক্লান্তি ও দুর্বলতা
রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরও যদি সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার শরীর সতেজ না লাগে, বরং ক্লান্ত ও অবসন্ন বোধ হয়, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
বৈজ্ঞানিক কারণ: ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীর ইনসুলিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স) অথবা পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ইনসুলিনের কাজ হলো রক্ত থেকে গ্লুকোজ বা শর্করাকে শরীরের কোষে পৌঁছে দিয়ে শক্তি উৎপাদন করা। যখন এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, তখন কোষগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না। ফলে সারা রাত বিশ্রামের পরও শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত ощущается।
২. রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া (Nocturnal Hypoglycemia)
ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ঘেমে যাওয়া, বিশেষ করে ঘামে পোশাক বা বিছানার চাদর ভিজে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে, তা অবহেলা করা উচিত নয়।
বৈজ্ঞানিক কারণ: এটি হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার লক্ষণ। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যারা ইনসুলিন বা নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ গ্রহণ করেন, তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা রাতে বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে। শরীর তখন অ্যাড্রেনালিনের মতো স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে শর্করার মাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা করে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অতিরিক্ত ঘাম, বুক ধড়ফড় এবং দুঃস্বপ্ন দেখা দিতে পারে।
৩. রাতে বারবার প্রস্রাবের বেগ (Nocturia)
রাতে ঘুম ভেঙে দুই বা তার বেশিবার প্রস্রাব করার জন্য বাথরুমে যেতে হলে, এটি ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান ও প্রাথমিক লক্ষণ।
বৈজ্ঞানিক কারণ: রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে কিডনিকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ পরিশোধন করার জন্য অনেক বেশি কাজ করতে হয়। এই অতিরিক্ত গ্লুকোজকে শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য কিডনি শরীর থেকে বেশি পরিমাণে পানি টেনে নেয়, ফলে ঘন ঘন এবং বেশি পরিমাণে প্রস্রাব তৈরি হয়। এই অবস্থাকে পলিনিউরিয়া (Polyuria) বলা হয়।
৪. ঘুমের মধ্যে তীব্র পিপাসা ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া
রাতে বারবার প্রস্রাব হওয়ার সরাসরি ফল হলো শরীরে পানির ঘাটতি বা ডিহাইড্রেশন।
বৈজ্ঞানিক কারণ: ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণে শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায়। এর ফলে মস্তিষ্ক তৃষ্ণার সংকেত পাঠায়, যার কারণে গভীর ঘুমের মধ্যেও তীব্র পিপাসা অনুভূত হতে পারে এবং মুখ শুকিয়ে যায়। বারবার পানি পানের জন্য ঘুম ভাঙা ডায়াবেটিসের একটি ক্লাসিক লক্ষণ।
৫. হাত-পায়ে ঝিনঝিন, অসাড়তা বা জ্বালাপোড়া
ঘুমের সময় বা বিশ্রামের মুহূর্তে হাত ও পায়ে সুই ফোটানোর মতো অনুভূতি, ঝিনঝিন করা, অবশ হয়ে যাওয়া বা জ্বালাপোড়া অনুভব করা একটি গুরুতর লক্ষণ।
বৈজ্ঞানিক কারণ: দীর্ঘ সময় ধরে রক্তে উচ্চ মাত্রার শর্করা থাকলে তা শরীরের স্নায়ুগুলোকে (Nerves) ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অবস্থাকে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি (Diabetic Neuropathy) বলা হয়। সাধারণত হাত ও পায়ের প্রান্তিক স্নায়ুগুলো প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে এই ধরনের অস্বাভাবিক অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
৬. অস্থির পা (Restless Legs Syndrome - RLS)
রাতে বিছানায় শোয়ার পর পায়ে এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি হওয়া এবং পা নাড়ানোর জন্য তীব্র ইচ্ছা তৈরি হওয়াকে রেস্টলেস লেগস সিন্ড্রোম বলে। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে RLS-এর প্রকোপ বেশি।
৭. ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট (Sleep Apnea)
স্লিপ অ্যাপনিয়া এমন একটি অবস্থা যেখানে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বার বার বন্ধ হয়ে যায় এবং আবার শুরু হয়। স্থূলতা টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং স্লিপ অ্যাপনিয়া—দুটোরই অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। এই দুটি রোগ একে অপরের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। উচ্চস্বরে নাক ডাকা এর একটি সাধারণ লক্ষণ।
উপরোক্ত এক বা একাধিক লক্ষণ নিয়মিত দেখা দিলে বিষয়টিকে হালকাভাবে না নিয়ে দ্রুত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসক আপনাকে কিছু পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন, যেমন:
ফাস্টিং ব্লাড সুগার (Fasting Blood Sugar): খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা।
HbA1c টেস্ট: গত ২-৩ মাসের গড় রক্তে শর্করার মাত্রা জানার জন্য এই পরীক্ষা অত্যন্ত কার্যকর।
ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT): শরীর কীভাবে গ্লুকোজ প্রক্রিয়াজাত করছে তা দেখার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ—উভয় ক্ষেত্রেই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস: ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার (শাকসবজি, ফল, ডাল), কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত শর্করা (লাল চাল, লাল আটা), এবং স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও ফ্যাট গ্রহণ করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনিযুক্ত পানীয় ও অতিরিক্ত মিষ্টি এড়িয়ে চলুন।
নিয়মিত শরীরচর্চা: সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম (যেমন দ্রুত হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো বা সাঁতার) করার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম: প্রতিদিন রাতে ৭-৮ ঘণ্টা শান্ত ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করুন। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম, ধ্যান (Meditation), বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করুন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বয়স ৩০ পেরোলে বা পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে বছরে অন্তত একবার রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করানো উচিত।
ঘুমের সময় শরীর যে সংকেতগুলো দেয়, তা আমাদের স্বাস্থ্যের আয়নার মতো। এই ছোট ছোট লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দিলে ভবিষ্যতে চোখ, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই সজাগ থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন (American Diabetes Association - ADA), মায়ো ক্লিনিক (Mayo Clinic), এবং ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, যুক্তরাজ্য (National Health Service - NHS, UK)।