বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখন থেকে কোনও আসনে একজন প্রার্থী থাকলে তিনি আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন না। এক্ষেত্রে একজন প্রার্থী থাকলে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে 'না' ভোটের সঙ্গে।
এছাড়া জোটের অংশ হয়ে এক দলের প্রার্থীরা আরেক দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে এবং নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সংক্রান্ত বিধানও বাদ দেওয়া হয়েছে।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে সংশোধনের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন।
সোমবার সকালে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে নবম কমিশন সভার মুলতবি বৈঠক হয়। পরে সন্ধ্যায় ইসির এই সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
তিনি জানান, নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে অপতথ্য বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
অন্যদিকে, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোটগত ভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও এখন থেকে নিজ নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। জোটের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীতে নির্বাচনে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। আর হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে বিজয়ী প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারবে ইসি।
সোমবারের বৈঠকে আরপিওর যে সব বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে সেগুলো ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পাঠানো হবে। পরে সরকারের সায় পেলে চূড়ান্ত করা হবে সংশোধিত আরপিও।
নির্বাচন কমিশন বলছে, নতুন করে ঐকমত্য কমিশনের কোনো সুপারিশ যদি থাকে সেগুলোও যুক্ত করা হবে সংশোধিত আরপিওতে।
'না' ভোট চালু, বাতিল হলো ইভিএম
২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে এটিএম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে 'না' ভোটের বিধান চালু করেছিল।
এ বিধান অনুযায়ী ব্যালট পেপারের সবশেষ প্রার্থীর স্থানে ছিল লেখা থাকে 'ওপরের কাউকে নয়' এবং ভোটারদের সহজ পরিচিতির জন্য মার্কা রাখা হয় 'ক্রস' (ঢ)।
তখন সারা দেশে মোট প্রদত্ত ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ ভোটের মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৩৭টি 'না ভোট' পড়েছিল।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর 'না' ভোটের বিধান বাদ দেয়া হয়।
এবার নতুন করে এ এম এম নাসির উদ্দিনের নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে 'না' ভোটের বিধান চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে 'না' ভোটের বিধান ছিল সব আসনে। তবে ইসি সব আসনে 'না' ভোটের বিধান চালু না করলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা রোধে শুধু একক প্রার্থী থাকলে তাকে 'না' ভোটের সঙ্গে লড়তে হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা রোধে এ ব্যবস্থা করেছে ইসি।
সোমবার বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, "যদি কোনো আসনে একজন প্রার্থী থাকে, তাকে বিনা ভোটে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে না। একজন প্রার্থী হলেও তাহলে তাকেও নির্বাচনে যেতে হবে। তার বিপক্ষ 'না' প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সেখানে যদি পুনরায় না বিজিত হয় তাহলে আর ভোট হবে না"।
অন্যদিকে, বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর ইভিএম ব্যবহার করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল। এখন নতুন করে আরপিও থেকেও তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মি. সানাউল্লাহ বলেন, "ইভিএম ব্যবহার হবে না। তাই যাবতীয় বিধান বিলোপ করা হয়েছে আরপিও সংস্কারের প্রস্তাবে"।
লটারির মাধ্যমে নির্বাচন বাদ
নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী দুইজন হলে লটারির মাধ্যমে জয়ী নির্ধারণ করা হতো। এখন থেকেই বিজয়ী নির্ধারণের এই পন্থা আর থাকছে না।
আরপিও সংশোধন নিয়ে সোমবারের বৈঠকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
বিদ্যমান আরপিও অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনী এলাকার ফলাফল একত্রীকরণের পর দেখা যায় যে, দুই বা ততোধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সম সংখ্যক ভোট পেলে প্রার্থীদের সামনে লটারির মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারণ করার বিধান ছিল। লটারি যে প্রার্থীর অনুকূলে পড়বে তিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য হবেন, যা তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন।
এই বিধান নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। যে কারণে এই বিষয়টি আগামী নির্বাচন থেকে আর থাকছে না। সোমবারের বৈঠকে লটারির বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে।
কমিশন সভা শেষে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, "গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আগে লটারির মাধ্যমে যে বিধান ছিল, যে ভোটের সংখ্যা দুইজন প্রার্থীর মধ্যে যদি সমান হয়ে যায় তাহলে লটারির মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের যে বিধান ছিল কমিশন সেটা থেকে সরে এসে বলছে।''
তিনি বলেন, "এক্ষেত্রে পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। লটারির মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচনের যে বিষয়টি এটা কমিশন সঠিক বলে মনে করে না"।
অন্যদিকে নির্বাচনে অনিয়ম হলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা চূড়ান্ত হলে নির্বাচনে কোনো আসনের ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ওই আসনের পুরো ভোট বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, "আরপিওতে নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত ও বাতিল নিয়ে যে বিধানগুলো ছিল, যেখানে পুরো কনস্টিটিয়েন্সির (আসন) নির্বাচন বাতিল বা ফলাফল বাতিল করার যে সক্ষমতা, সেটাকে সীমিত করা হয়েছিল। সেটা আবার পুনঃ-স্থাপন করা হয়েছে, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন অবস্থা বুঝে নির্বাচন স্থগিত করা, এক বা একাধিক বা সমস্ত কনস্টিটিয়েন্সির ফলাফল বাতিল করতে পারবে"।
'জোটবদ্ধ নির্বাচনে অন্য দলের প্রতীক ভোট নয়'
বিভিন্ন সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ছোট ছোট রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধভাবে ভোটে অংশ নিয়ে শরীক দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারতো।
কিন্তু এখন থেকে, জোটগত ভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, এমন বিধান করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সোমবারের বৈঠক শেষে কমিশনার মি. সানাউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, "এককভাবে দলীয়ভাবে নির্বাচন করবে, নাকি জোটবদ্ধভাবে করবে সেটা রাজনৈতিকদল গুলোর স্বাধীনতা। যে প্রভিশনটা এখানে সংস্কার কমিশনও প্রস্তাব করেছে। সেটা কমিশনও একসেপ্ট করেছে। সেটা হচ্ছে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও রাজনৈতিক দলসমূহ তার নিজের রিজার্ভ প্রতীক আছে সেটা দিয়ে নির্বাচন করবে, কোনও একটি প্রতীক দিয়ে নয়"।
এই বৈঠকেই ইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে কোন প্রার্থী নির্বাচনি হলফনামায় ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিলে বিজয়ী হওয়ার পরও তার প্রার্থিতা বাতিল করার সুযোগ থাকবে ইসির হাতে।
এছাড়া নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের অপব্যবহার রোধে উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
অন্যদিকে, নির্বাচনের ভোট গণনার সময় সাংবাদিকরা গণনা কক্ষে থাকতে পারবে বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
কমিশনের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোট গণনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই কক্ষে অবস্থান করতে হবে গণমাধ্যমকর্মী।
সোমবারের বৈঠকে আরপিওতে যে সংশোধনী আনা হয়েছে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।