খোকন আহম্মেদ হীরা : এক সময় সদরঘাটের যাত্রীরা জিম্মি ছিলেন লাল বাহিনীর হাতে। সব কিছুতেই লাল বাহিনীকে হিস্যা দিতে হতো। সেই বাহিনীর দৌরাত্ম্য এখন আর না থাকলেও জিম্মিদশা থেকে মুক্তি মেলেনি এখানকার নদীবন্দর হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন রুটে ভ্রমণকারী লঞ্চের যাত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের। এখন ‘খলিফা বাহিনী’র হাতে জিম্মি হয়ে পরেছেন দক্ষিণাঞ্চলের লাখো যাত্রীসহ লঞ্চের স্টাফরা।
জানা গেছে, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে হকার উচ্ছেদ করলেও এর সুফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে প্রতিটি লঞ্চেই ভ্রাম্যমাণ হকারদের দখলে। যাত্রীদের নানারকম হয়রানি করা, সুযোগ বুঝে মালামাল চুরি করা, এমনকি অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের সাথে যোগসাজশসহ বিস্তার অভিযোগ রয়েছে এসব ভ্রাম্যমান হকারের বিরুদ্ধে।
হামলার আশংকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণাঞ্চলগামী একাধিক লঞ্চের স্টাফরা জানান, খলিফা বাহিনীর প্রধানের নাম আসাদ খলিফা। তিনি বন্দরসংলগ্ন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড (সূত্রাপুর) এলাকার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা। একাধিক ভূক্তভোগিরা জানান, সদরঘাট নৌবন্দরে খলিফা বাহিনীর এতোটাই আধিপত্য যে, ওই এলাকায় তার ডিলারশিপ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের পানি ছাড়া অন্যকোনো ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি পর্যন্ত বিক্রি করা যায়না। এছাড়া লঞ্চের ক্যান্টিনের জন্য তার বাহিনীর কাছ থেকে মাছ, মুরগি ইত্যাদি বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে লঞ্চ মালিকদের। শুধু তাই নয়, এ বাহিনীর মদদে লঞ্চের ক্যান্টিন দখলে নিয়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে তৃতীয়পক্ষের কাছে। লঞ্চে হকার বসিয়ে অধিক মুনাফায় নিন্মমানের পানি বিক্রি, ক্যান্টিনে চড়া দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহ এবং ক্যান্টিন দখল করে ভাড়া দেওয়ার বদৌলতে দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ৮০টি লঞ্চ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে খলিফা বাহিনী। এ বাহিনীর জিম্মি দশায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রী, লঞ্চ মালিক ও স্টাফদের।
ফারহান লঞ্চের মালিকপক্ষের এক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আসাদ খলিফা উল্লেখিত তিনটি ব্র্যান্ডের পানির ডিলার। দীর্ঘদিন ধরে জোরপূর্বক ওই তিন ব্র্যান্ডের পানি প্রতিটি লঞ্চে সরবরাহ করছেন আসাদ খলিফার লোকজনে। এ নিন্মমানের পানি রাখতে অপরাগতা প্রকাশ করলে আসাদ খলিফার লোকজনে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। এছাড়াও সামান্য কোন ঘটনা ঘটলেই তারা লঞ্চে হামলা চালায়।
একাধিক লঞ্চ মালিকরা অভিযোগ করেন, টার্মিনালে যাত্রী হয়রানি বন্ধে বিআইডব্লিউটিএর টিম অনেকদিন ধরে হকার উচ্ছেদ করে আসছে। কিন্তু আসাদ খলিফার লোকজন প্রতিটি লঞ্চের ভেতরে এসব হকারকে দিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়েছে। এতে বাঁধা দিলে লঞ্চে হামলা ও ভাঙচুরের হুমকি দেওয়া হয়। থানা পুলিশে অভিযোগ দিলেও কোনো লাভ হচ্ছেনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লঞ্চের মধ্যে থাকা ভ্রামম্যান একাধিক হকাররা বলেন, প্রতিদিন শেষে বিকেলে লঞ্চ ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে তিন শতাধিক হকারের কাছ থেকে আসাদ খলিফার নিয়োগকৃত লাইনম্যানরা হকারপ্রতি ২৭০ টাকা করে আদায় করছে। এতে প্রতিদিন চাঁদা আসে ৮১ হাজার টাকা।
সূত্রমতে, বিআইডব্লিউটিএ সদরঘাট টার্মিনাল থেকে হকার উচ্ছেদে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে থাকে। আদালতের নির্দেশে গত মঙ্গলবারও পুরান টার্মিনালের ২৭টি দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে। যাত্রী হয়রানি বন্ধ এবং টার্মিনালটির আধুনিকায়নে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর এমন ভাষ্য হলেও নতুন করে লঞ্চের ভেতরে হকার বসানোর বিপরীতে অদৃশ্য কারণে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) আলমগীর কবির সাংবাদিকদের বলেন, যাত্রী হয়রানি বন্ধসহ ঘাটের পরিবেশ ঠিক রাখতে টার্মিনালে কোনো হকার থাকবে না। লঞ্চের ভেতরে যেসব হকার বসেছে, তাদেরও উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। কিন্তু হকারদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে তারা শুধু রমজান মাসে ব্যবসা করার সুযোগটা চেয়েছেন। তবে আমরা লঞ্চের ভেতরে তাদের ৩০ মে পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। এরপর বিআইডব্লিউটিএ এলাকার মধ্যে কোনো হকার থাকতে পারবে না। জোরপূর্বক নিন্মমানের পানি, মুরগি, মাছ সরবরাহ ও ক্যান্টিন দখলের বিষয়ে অভিযোগ আসলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও যুগ্ন পরিচালক উল্লেখ করেন।