মহসিন উল হাকিম : লম্বা সফরে বিক্ষিপ্তভাবে দেখেছি সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি। দেখেছি বনের ওপর মানুষের অত্যাচারের চিত্র। সেই অথ্যাচার সহ্য করে অসম্ভব প্রাণশক্তি নিয়ে সুন্দরবনকে আবার ঘুরে দাঁড়াতেও দেখেছি। জোয়ার-ভাটা, গোন- মরা গোন, নানান মৌসুমে জেলে-বাওয়ালীদের কাজ কারবার আর জীবনযাপন দেখেছি নিজের চোখে। দেখছি এখনও...।
বনদস্যুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে ছুটতে হয়েছে সুন্দরবনের গহীন বনে। গেলো নয় বছরে বন বিভাগের কর্তাদের জানিয়ে, কখনও বা লুকিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি অসংখ্য নদী-খাল। ফেসবুকে সেই খাল-নদীগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি বিক্ষিপ্তভাবে। আড়পাঙ্গাসিয়ার প্রান্তে বড় খাল, বেহালার শুরু।
একটু এগিয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে আরেকটি খাল, নাম কয়লা। মনে হয় দুই ভাই বোন। নাম শুনলেও যেতে ইচ্ছা করে, দেখতে ইচ্ছা করে। দস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কয়েক বারই গিয়েছি এ অঞ্চলে। তবে মুখ্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খালগুলোর ছবি সেভাবে তুলতে পারিনি। ফোনের গ্যালারি খুঁজে বিক্ষিপ্তভাবে তোলা কিছু ভিডিও দেখতে গিয়েই লিখতে বসলাম।
আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে শুরু করে বড় খাল, বেহালা বের হয়েছে মালঞ্চ নদীর মোহনায়। নদীর উল্টোপাশে দূরে আবছা দেখা যায় যে বন, সেটি উত্তর তালপট্টি। আর কয়লা খালটিও শেষ হয়েছে মালঞ্চে গিয়ে। মাইট্যে খালের একটু আগে যেখানে কয়লা বের হয়েছে, সেই জায়গাটির সৌন্দর্য অশরীরী। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সব সময়ই সেখানে কেন জানি ট্রলার উল্টিয়ে ফেলার মতো ঢেউ আর ¯্রােত থাকে। বন বিভাগ ঘোষিত নিষিদ্ধ এলাকা এই খালগুলো। মানে হলো, এই অঞ্চলকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার চেষ্টা করছে বন বিভাগ। কিন্তু সেটা তো আর বাংলাদেশের সিস্টেমের বাইরে নয়। নানাভাবে লুকিয়ে বা ম্যানেজ করে কিছু ব্যবসায়ী এই অঞ্চলে মাছের ব্যবসা করে।
(এই অঞ্চলে কেমন মাছ পাওয়া যায়, সে বিষয়ে আরেকদিন লিখবো... মাছের দাম কেমন পায় জেলেরা, সেই মাছ বাজারে কতো টাকায় বিক্রি হয়, এ নিয়ে বিস্তারিত লিখবো আরেকদিন)।
যা হোক, অভয়াশ্রম বা নিষিদ্ধ এলাকা হলেও আমার চলার পথে জেলেদের আনাগোনা দেখেছি। লুকিয়ে লুকিয়ে তারা মাছ কাকড়া ধরে সেখানে। আমাকে চেনে, জানে আর বিশ্বাস করে বলে সব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন জেলেরা। যাক প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ভাবছিলাম, বঙ্গোপসাগরের মুখে আস্ত ট্রলার নিয়ে যেখানে চলাফেরা করতে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তারা চলাফেরা করে কী করে? আসলে জন্ম থেকে উপকূল আর সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল এই মানুষদের কাছে এটা ভাবনার বিষয় নয়।
ডিঙ্গি নৌকায় কয়েকদিনের খাবার নিয়ে নাও ভাসায় তারা। ছোট ছোট খাল ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে পৌঁছে যায় তারা। অবশ্য জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জায়গায় পৌঁছতে তাদের সময় লেগে যায় দু’দিন। একইভাবে ফিরতেও সময় লাগে দু’দিন। এর মধ্যে বন বিভাগ, বিশেষ স্মার্ট টিম বা কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়লে অবশ্য গ্রেফতার এড়ানোর সুযোগ থাকে না। তাই সেই ঝুঁকি কমিয়ে আনতে তারা অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করে। সেই পদ্ধতির কথাও আরেকদিন বলবো। আর এতোকিছু সামাল দিয়ে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যে মানুষগুলো মাছ ধরছে, তাদের পকেট কী ভরছে? সে নিয়ে আরেকদিন লিখবো।
বলছিলাম, সুন্দরবনের বেহালা-কয়লা খালের কথা। বর্ষায় সাগরের মাছ ঢুকে পড়ে এসব খালে। বড়শি ফেললে এ সময় বড় মাছ পাওয়া যায়। আমিও পেয়েছি দু’একবার। জেলেদের জালে আর বড়শিতে এ সময় ধরা পড়ে বিশাল বিশাল মাছ। জাল ভরে ওঠে চাকা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি আর গলদা চিংড়ি। শীত মৌসুম ছাড়া বছরের বাকিটা সময় বড় নদী আর খালে অ্যাংকর করে দাঁড়ানো যায় না, উত্তাল বাতাস, ¯্রােত আর ঢেউয়ের কারণে। আর বর্ষায় অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে সেখানে গেলে ছোট খালের ভেতরেই রাত কাটাতে হয় আমাদের। বেহালার মুখ থেকে সূর্যোদয় আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয়। মনে হয় যেন বিশাল এক আগুনের থালা চোখের সামনে।
পূর্ণিমায় চাঁদটা যেন হাতের কাছে নেমে আসে। আর অমাবষ্যায় তারাগুলো ধরে ধরে গোনা যায়। বর্ষায় প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই বৃষ্টি থাকে। তাই সেসময় সুন্দরবনের এসব এলাকায় বেশিদিন টিকে থাকা মুশকিল। আর শীতে ঠা-া বাতাস থেকে শরীরটাকে রক্ষা করতে জান বের হয়ে যায়। তারপরও সেখানে যেতে ইচ্ছা করে বারবার।
কিছুদিন আগে এর আশপাশের এলাকা ঘুরে এলাম। এরই মধ্যে বনের গাছগুলোতে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ফুটবে খলশে ফুল। তারপর কালী লতা, বাইন, কেওড়া, গড়ানের ফুল ফুটবে। মধুর টানে সেই ফুলগুলোতে জড়ো হবে মৌমাছি। জানা-অজানা নানা রকমের বুনোফুলগুলো দেখি না অনেকদিন। (অভয়াশ্রম হওয়ায় এই অঞ্চলে পর্যটকদের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বন বিভাগ আমাকে একটু প্রশ্রয় দেয়। সেই সুযোগে আমি মাঝে মাঝে কাজে-অকাজে ঘুরতে যাই। তাই ট্যুরিস্টদের সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো...)। লেখক : সাংবাদিক। ফেসবুক থেকে