ড. এমদাদুল হক : কখন, কোথায়, কীভাবে, কার সঙ্গে, কতোক্ষণ ঘুমানোর প্রস্তুতি নেবো, তা নির্ণয়ের স্বাধীনতা আমাদের আছে, কিন্তু ঘুমানো কিংবা না ঘুমানোর স্বাধীনতা আমাদের নেই। শব্দঘড়ি ব্যবহার করে ঘুম থেকে ওঠা সম্ভব। কিন্তু শব্দঘড়ি ব্যবহার করে ঘুমোনো অসম্ভব। কে আছে এমন, যে ঘড়ি সংকেত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে যাবে? যে শক্তির কার্যে বর্ষা ঘুরে বর্ষা আসে, যে শক্তির কার্যে পৃথিবী আবর্তিত হয়, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র স্ব স্ব কার্য সম্পন্ন করে, সেই একই শক্তি প্রত্যেক জীবকে ঘুম পাড়ায় ও জাগিয়ে তুলে। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। ঘুমের মধ্যে কী হয়, তা আমরা জানি না। তার মানে, জীবনের এক-তৃতীয়াংশ আমরা জানি না। শুনেছি, নিজেকে জানাই নাকি ঈশ্বরকে জানা। ঘুমের মধ্যে কী হয়, তা যদি জানা না থাকে, তবে নিজেকে জানা এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, ঈশ্বরকে জানাও এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। নিদ্রা বিলাসতা নয়, নিদ্রা কোনো সাম্প্রদায়িক আচার-অনুষ্ঠান নয়। নিদ্রা জীবনের প্রয়োজন। জীবনের এই প্রয়োজন মেটানোর মধ্যেই জীবন সমৃদ্ধ হতে পারে, শান্তি ও আনন্দে ভরে যেতে পারে। প্রতিদিন জীবনের প্রয়োজনে কর্মের মাধ্যমে আমরা যে সত্যের মুখোমুখি হই তা-ই ধর্ম। নিদ্রার প্রতিটি ক্ষণ আমরা অসাধারণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাই- যার পর্যবেক্ষণ আমাদের দিতে পারে মহাসত্যের উপলব্ধি। যে অবস্থাকে আমরা জাগৃতি বলি তাও প্রকৃত অর্থে জাগৃতি নয়। অধিকাংশ মানুষ জেগে জেগে ঘুমায় আর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু জানেই না যে সে ঘুমিয়ে আছে। কদাচিৎ জীবন-মৃত্যুর সম্মুখীন হলে মানুষ পরিপূর্ণ জেগে ওঠে। মানুষ জেগে জেগে ঘুমায় বলেই জীবন চলার পথে বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং মানুষের প্রতিটি স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। কেউ কেউ সারাজীবনই ঘুমায়। রাজনীতির মদ, ধর্মের আফিং মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে সারাজীবন।
আমরা কী এখন জেগে আছি? পূর্ব ধারণা কী আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখেনি? অতীত শাস্ত্র ও মতবাদ কী আচ্ছন্ন করে রাখছে না আমাদের চেতনা? অতীতের প্রয়োজন আছে। কিন্তু যে অতীত বর্তমানকে গ্রাস করে ফেলে সে অতীতের প্রয়োজন কী? বর্তমানকে দেখার জন্য যে সচেতনতার প্রয়োজন তা আছে কী? যদি তা না থাকে, তবে সজাগতা নেই। শুধু চোখ খোলা রাখা ও হাঁটাচলা করাই সজাগতা নয়। সজাগ থাকা হলো নিজের মধ্যে এবং নিজের চারপাশে যা কিছু ঘটছে, তা মনোযোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করা।
সজাগ থাকা মানে বর্তমানে থাকা। হাঁটার সময় পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে হাঁটি। যেন হাঁটছি এমন পথ দিয়ে, যে পথের দু’ধারেই কাঁটা। যেদিক দিয়ে হাঁটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো খেয়াল রাখি। জাগ্রত জীবনযাপনের এটিই উপায়। কে কী করছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কীভাবে করছ তা-ই গুরুত্বপূর্ণ। যা-ই করি না কেন, পূর্ণ সজাগ থাকি। তাহলে গভীর নিদ্রাতেও সচেতনতা থাকবে।
সচেতন নিদ্রায় ঘুমের বিশাল সময়টিকেও আমরা ব্যবহার করতে পারি আত্মবিকাশের প্রয়োজনে। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও হৃদপি- ও মস্তিষ্ক সজাগ থাকে। জাগ্রত অবস্থায় যেমন সচেতনতা ঘুমিয়ে থাকতে পারে তেমনি ঘুমন্ত অবস্থায় সচেতনতা জাগ্রত থাকতে পারে। ঘুমানোর আগে মস্তিষ্ককে কাজ দিয়ে যদি আমরা ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস করতে পারি তাহলে দেখা যাবে যে, মস্তিষ্ক তার কাজ অনেকটাই করে রেখেছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলার আগেই স্মরণে আসবে সেই কাজের কথা। ঘুমানোর আগে এবং ঘুম ভাঙার পরে মস্তিষ্ক-তরঙ্গের কম্পাঙ্ক প্রতি সেকেন্ডে ৮ থেকে ১৩ চক্রে বর্তিত হয়। একে বলা হয় আলফা তরঙ্গ। আলফা তরঙ্গের কম্পাঙ্ক আরেকটু কমে গেলে থিটা তরঙ্গ শুরু হয়। থিটা মস্তিষ্ক-তরঙ্গের কম্পাঙ্ক প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে ৭ চক্রে থাকে। থিটা স্তরে মস্তিষ্ক তার বর্জ্য পরিষ্কার করে। আবেগভূমি থেকে উদ্বেগ দূর হয়। চিন্তাগুলো বিন্যস্ত হয়। থিটা হলো অবচেতন মনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সরুপথ। এ স্তরে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়, স্বপ্ন আসে।
এরপর রয়েছে গভীর নিদ্রাকালীন ডেল্টা মস্তিষ্ক-তরঙ্গ। এই স্তরে মস্তিষ্ক-তরঙ্গের কম্পাঙ্ক প্রতি সেকেন্ডে ০.৫ থেকে ৩ চক্রে বর্তিত হয়। এই স্তরে স্বপ্ন থাকে না। আমি-তুমি ভেদ থাকে না। একে বলা হয় সুষুপ্তি। তার মানে ঘুমের মধ্যে আমরা ধ্যান ও সমাধির প্রত্যেকটা স্তর অতিক্রম করি। ধ্যান হলো কৃত্রিম নিদ্রা। আর নিদ্রা হলো প্রাকৃতিক ধ্যান। ঘুমের মধ্যে সজাগ থাকা হলো নিদ্রার মারেফাত। আর ঘুমের মধ্যে একত্বের উপলব্ধি হলো মারেফাতের নিদ্রা। মারেফাতের নিদ্রায় দেহ নিশ্চল থাকে কিন্তু চেতনা জাগ্রত থাকে। ফেসবুক থেকে