হাসান মাহমুদ : সেই স্কুল আজো আছে, নেই শুধু এক অসাধারণ শিক্ষয়িত্রী যিনি ধ্বংসের করাল গর্জন শুনেছিলেন সঙ্গীতের মতো, মাতৃভাষাকে দানবের হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা করার জন্য। ব্রাহ্মনকন্যা পাড়ি দিলেন দুস্তর সাগর-মরু-পর্বত, আব্দুল মান্নাফের হাত ধরে অতিক্রম করে গেলেন জাত-ধর্মের গ-ী, কল্যাণী রায়চৌধুরী থেকে হলেন মমতাজ বেগম...
মাতৃভাষার আর্ত আহ্বানে টালমাটাল বাহান্নোর পূর্ব পাকিস্তান। সেই ছোট্ট শহরটাতেও আছড়ে পড়েছে ঢাকার ঢেউ। স্কুলের বইখাতা ছুঁড়ে ফেলে জীবনের বৃহত্তর ব্রত শেখাতে পথে নেমেছেন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। সমস্ত শহর তার পেছনে উত্তাল। প্রমাদ গুনলো ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী। সেই রক্ষণশীল সমাজে শিক্ষয়িত্রীকে গ্রেপ্তার করা হলো। উত্তাল জনতা তুলে ফেললো দশ হাজার টাকার জামিন- সেটা নাকচ হলো (বাহান্নোর ১০ হাজার টাকা এখনকার ১০ লক্ষ, তাকে ভালোবেসে চাঁদা দিয়ে তুলেছিলো সাধারণ মানুষ)। পুলিশ ভ্যানে তাকে ঢাকা পাঠানোর পথে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো তার হাজার হাজার উন্মত্ত ভক্তের দল। একশ’ ষাটটা গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলিশের ওপরে। পুলিশের আর্তনাদে ছুটে এলো ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, সেই ছোট্ট শহরের ইতিহাসে এই প্রথম জারি হলো ১৪৪ ধারা। গ্রেপ্তার হলো ১১৫ জন, ২ জন ছাত্রীসহ।
প্রধান শিক্ষয়িত্রীর গ্রেপ্তারের খবরে তখন সারা দেশে ক্ষোভের আগুন। সরকার গিয়ে পড়লো খাদ্য পরিদর্শক আব্দুল মান্নাফের কাছে। ছুটে এলো স্বামী প্রবর - ‘যা হয়েছে হয়েছে, এখন ওই মুচলেকায় সই করে ঘরে ফিরে চলো’। মুচলেকা হলো- ‘যাহা করিয়াছি আর কদাপি করিবো না’। অবাক হয়ে তিনি চেয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। এই সেই স্বামী যার জন্য একদিন বাবা-মা পরিবার ধর্ম সবকিছু ছেড়েছিলেন তিনি। মাতৃভাষা বাঁচানোর জন্য তার সংগ্রাম, স্বামীর সমর্থনই তো দরকার সবচেয়ে আগে! কিছুতেই রাজি হলেন না, এবারে এলো তালাকের হুমকি। রাজি হলেন না তবু, হয়ে গেলো তালাক। তিনি ঘর হারালেন, চাকরি হারালেন কিন্তু যক্ষের মতো, মায়ের মতো আগলে রাখলেন মাতৃভাষাকে
কলকাতা হাইকোর্টের সম্ভ্রান্ত বিচারক রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায় ও শিক্ষিকা মাখনমতি দেবীর কতো আদরের একমাত্র মেয়ে কল্যাণী রায়চৌধুরী। তার সম্ভ্রান্ত জীবনে এসেছিলো কার্তিকের ময়ূর ১৯৪৬ সালে। ব্রাহ্মনকণ্যা পাড়ি দিলেন দুস্তর সাগর-মরু-পর্বত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আব্দুল মান্নাফের হাত ধরে অতিক্রম করে গেলেন জাত-ধর্মের গ-ী- কল্যাণী রায়চৌধুরী থেকে হলেন মমতাজ বেগম...
অন্য সব কষ্ট নিতে পারতেন কিন্তু স্বামীর প্রবঞ্চনা সহ্য করতে পারলেন না, দীর্ঘ আঠারো মাস কারাগারে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে এলো তার শরীর। ঢাকার আনন্দময়ী গার্লস স্কুল আর বাওয়ানী একাডেমিতে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেন। কেউ জানলো না ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ ধীরে ধীরে নিভে এলো তার মৃত্যুহীন প্রাণ। কেউ জানলো না একান্ত অনাড়ম্বরে আজিমপুর গোরস্থানে তিনি চলে গেলেন মহা প্রস্থানের পথে চিরনিদ্রায়। সেই কবর কোথায় তাও আজ কেউ জানে না। একমাত্র সন্তান খুকু তখন বিদেশে।
আজ তিনি নেই। দেখেও গেলেন না ২০১৬ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়েছে, তার প্রিয় স্কুলের সামনের রাস্তার নাম হয়েছে ‘ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’। ইতিহাস তাকে ভুলে গিয়েছিলো, যিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন।
সেই শহরের নাম নারায়ণগঞ্জ, সেই স্কুলের নাম মর্গান গার্লস স্কুল। সে স্কুল আজো আছে, নেই শুধু এক অসাধারণ শিক্ষয়িত্রী যিনি মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য ধ্বংসের করাল গর্জন শুনেছিলেন সঙ্গীতের মতো.....
তথ্যসূত্র :-
* জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা ১৪১ - ১৪২।
* ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম : আজীবন বিপ্লবী এক নারীর ভুলে যাওয়া অধ্যায়, আসিফ মহিউদ্দীন।
* আমার ‘বাংলার কথা কই’ বইয়ের একটি অধ্যায়।