বিভুরঞ্জন সরকার : ১৪ ডিসেম্বর সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। তিনি বর্তমানে রাজনীতিতে অত্যন্ত আলোচিত একটি নাম। তাকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল। তাকে নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্নও আছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদেই খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। তার পরিচিতি, সম্মান সব কিছুর পেছনেই বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বা অবদান আছে। তিনিও তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্বীকার করেন। তাই তিনি আওয়ামী লীগ ছাড়ার তিন দশক পরেও বঙ্গবন্ধুকে ছাড়েননি। তবে তিনি এবার এক অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করা, বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা, বিতর্কিত করার জন্য বিএনপি নামক যে রাজনৈতিক দলটির জন্ম হয়েছে, সেই বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি বিএনপির খাঁচায় ঢ়ুকিয়েছেন। বিএনপিকে নিয়ে যখন ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেন তখন অবশ্য বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে কোনো বৃহত্তর ঐক্যে তিনি যাবেন না। কিন্তু বিএনপি যখন জামায়াতকে নিয়েই বৃহত্তর ঐক্য করলো, নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক ধার দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ দিলো, এমন কি ঐক্যজোট থেকে জামায়াতকে বেশি আসন দিয়ে বড় দলের স্বীকৃতি দিলো তখন ড. কামাল হোসেন আর কোনো কথা বলেন না। ফুলের জলসায় নীরব কবির মতো তিনি জামায়াতের ব্যাপারে মুখ খোলেন না। তার এই রহস্যময় নীরবতা, এতোদিনের জামায়াতবিরোধিতা কীভাবে জামায়াতপ্রীতিতে পরিণত হলো সেটা জানার আগ্রহ সবার। সাংবাদিকদের মধ্যে এই আগ্রহ আরো বেশি প্রবল। কারণ মানুষকে সঠিক তথ্য জানানোর দায়িত্ব তারাই পালন করেন।
জামায়াত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। ঘাতক-দালালদের দল জামায়াত আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এমন একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়ার বিষয়টি স্ববিরোধী কি না তা ড. কামাল হোসেনের কাছে জানতে চাওয়াটা কোনোভাবেই অপরাধ হতে পারে না। অথচ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে একজন সাংবাদিক ড. কামালকে জামায়াতের প্রশ্নে তার অবস্থান জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সাংবাদিকের কাছে উল্টো জানতে চান, এই প্রশ্ন করার জন্য কতো পয়সা পেয়েছো? তিনি প্রশ্নকারী সাংবাদিকের নাম-প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চেয়ে তাকে ‘চিনে’ রাখার কথাও বলেন। এক পর্যায়ে তিনি সাংবাদিককে ‘খামোশ’ বলেন।
ড. কামাল যা যা করেছেন তার কোনোটাই তার নাম-পদ-সম্মানের সঙ্গে মানানসই হয়নি। একজন রাজনৈতিক নেতাকে রাজনৈতিক প্রশ্ন করা সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব এবং অধিকারের মধ্যে পড়ে। এখানে ‘পয়সা’ পাওয়ার কথা বলে ড. কামাল কি সুরুচির পরিচয় দিয়েছেন? তিনি পয়সা নিয়ে মক্কেলদের পক্ষে দাঁড়ান বলেই হয়তো পয়সার কথাটাই তার প্রথম মনে এসেছে। তাকে যদি প্রশ্ন করা হতো, জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করে কতো টাকা পেয়েছেন তাহলে তিনি ক্ষিপ্ত হলেও না হয় বোঝা যেতো!
তিনি সাংবাদিককে চিনে রাখার কথা বলে কি খুব ভালো কাজ করেছেন? তাকে কি শুধু তার পছন্দমতো প্রশ্ন করতে হবে? কোনো অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি তিনি হবেন না? তিনি যে ‘খামোশ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন, তার অর্থ কি তিনি জানেন? বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী খামোশ অর্থ চুপ থাকার নির্দেশ বা চুপ থাকো। এটা কি একজনের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়? ড. কামাল হোসেনরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চান কিন্তু আবার সাংবাদিকের কণ্ঠও রোধ করতে চান।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে। নানামুখী চাপে হয়তো মেজাজ খারাপ ছিলো, এটাকে এতো বড় করে দেখার কিছু নেই। না, এমন ছেলে ভোলানো কথা গ্রহণযোগ্য নয়। বয়স বাড়লে বিনয় না বেড়ে যার রাগ বাড়ে, তার তো রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া উচিত। যিনি নিজে অন্যদের গণতন্ত্রের সহবত নিয়ে হামেশা নসিহত করেন, তিনি নিজে যদি স্বৈরমানসিকতার অধিকারী হন সেটা কি ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারে? রুগ্ন রাজনীতির সমালোচনা যিনি করেন, তার কাছে মানুষ তো সৌজন্য-শিষ্টাচারের পাঠ নেবে।
আমাদের দেশে এর আগেও একজন রাজনীতিবিদ ‘খামোশ’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। তিনি মজলুম জননেতা পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও রাজনৈতিক গুরু। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি খামোশ শব্দটি উচ্চারণ করতেন কোলাহল, গোলযোগ থামানোর জন্য, বিরুদ্ধ মত বন্ধ করার জন্য নয়। তাছাড়া কোনো কোনো শব্দ ব্যবহারের অধিকারও কেউ কেউ অর্জন করেন। মওলানা ভাসানী খামোশ বললে সেটা কারো কাছে বেমানান লাগতো না, যেমন ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি’ বলার অধিকারও অর্জন করেছিলেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুই।
ড. কামাল হোসেনের মুখে খামোশ বেমানান। কাউকে খামোশ বলার অধিকার তিনি অর্জন করেননি। সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা বহন করে জীবনসায়াহ্নে এসে বিপরীত পথে হাঁটতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন কামাল হোসেন। তার ছুটির সময় যে এসে গেছে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার রাগ হওয়ার ধরন দেখে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।