কামরুল হাসান মামুন, ফেসবুক থেকে: ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক বিভাগের N সংখ্যক ছাত্র X রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ওই বিভাগের তাদেরই একজন শ্রেণি শিক্ষক Y রাজনীতির সাথে actively জড়িত। ওই শিক্ষক নিয়মিত টক্-শোতে যায়। ওখানে নিজ দলের সাফাই গাইতে সত্য মিথ্যা যা বলার দরকার বলে আর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করার জন্য সত্য মিথ্যা যা বলার দরকার বলে। শ্রেণীকক্ষে এইরকম একজন শিক্ষককে তার বিপক্ষ রাজনৈতিক দল করা ছাত্রটি কেমনভাবে গ্রহণ করবে? তার প্রতি ওই X রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছাত্রদের কেমন শ্রদ্ধা থাকবে? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা নিলে এই অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে। অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় শ্রদ্ধাতো থাকবেই না, উল্টো রাগ আর ঘৃণা থাকবে এবং সুযোগ পেলে অপমান কিংবা গায়ে হাত দিতেও কুন্ঠাবোধ হবে না।
আমি সব সময় বলি যে, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের lecture মানে শিক্ষক থেকে ছাত্রের মাঝে জ্ঞানের প্রবাহের ব্যবস্থা করা। এ যেন অনেকটা পানির প্রবাহের মত। পানি যেমন উঁচু থেকে নিচের দিকে যায়, ঠিক তেমনি জ্ঞানের স্বচ্ছন্দ প্রবাহের জন্যও জ্ঞান এবং শ্রদ্ধার একটি ঢালের প্রয়োজন। অর্থাৎ শিক্ষক শুধু বেশি জানলেই হবে না, সাথে সাথে তার প্রতি ছাত্রদের সম্মানবোধও একান্ত প্রয়োজন। এই সম্মানবোধ টা এমনি এমনি আসবে না। এটা শিক্ষককে অর্জন করতে হয়। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা আছে। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে রাষ্ট্র যদি শিক্ষকদের উঁচু স্থানে রাখার ব্যবস্থা করে সেটা ছাত্র-শিক্ষকের ঢাল তৈরিতে সহায়ক হয়। আমাদের রাষ্ট্র যারা চালায় বা চালিয়ে আসছে তারা এই জিনিসটা বুঝেনি বা বুঝতে চায়নি। দিনদিন আমরা এমন একটি বাঁকের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে শ্রদ্ধা করার মত শিক্ষক এখন খুঁজে পাওয়া যায় না।
একজন ছাত্র যখন জানবে শিক্ষক অনেক জ্ঞানী এবং আদর্শবান তখন শ্রদ্ধা অটোমেটিক আসবে। এখন শিক্ষক যদি এমন হয় যে, একটি পদ পদবীর জন্য দিনরাত শিক্ষকতা রেখে রাজনীতিকদের পেছনে ঘুরঘুর করছে, তাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হতে কুন্ঠাবোধ করছে না, দুটো পয়সা অতিরিক্ত আয় করার জন্য ক্লাসের বাইরে টাকার বিনিময়ে পড়াচ্ছে তাহলে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধ জন্মাবে কিভাবে? রাষ্ট্রকে এমন সমাজ গড়ে তুলতে হবে যাতে সত্যিকারের ভালো ছাত্ররা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হয়। রাষ্ট্রকে এমন বেতন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শিক্ষকদের অতিরিক্ত টাকা আয়ের পেছনে ছুটতে না হয়। শিক্ষকদের বুঝতে হবে যে শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যার মাধ্যমে টাকার অংকে বড়লোক হওয়া যায় না। শিক্ষককে বুঝতে হবে যে, শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে সে সারা জীবন জ্ঞানের প্রবাহের মধ্যে থাকার সুযোগ পায়। অর্থাৎ সে সারা জীবনভর শিখবে আর এটাই তার পেশা। নিজেকে সতত উন্নত করার এমন আর কোন পেশা নেই। তাই শিক্ষকতা অন্য পেশার সাথে তুলনীয় নয়। তাই শিক্ষকদের মর্যাদা রাষ্ট্রের warrant of precedence দিয়ে নির্ধারণের বিষয় না।
মোরাল অফ দি পোস্ট: শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতি করা উচিত নয়। টক্-শোতে গিয়ে তাদের গলাবাজি করা উচিত না। এতে সমাজে শিক্ষকদের শ্রদ্ধার ঢাল কমে যায়। তবে কেউ যদি একটি আদর্শকে ধারণ করে একটি রাজনীতি করেন এবং সেই দল ভালো কাজ করলে প্রশংসা এবং মন্দ কাজ করলে খুবই নির্মোহভাবে সমালোচনা করতে দ্বিধা না করেন তাহলে রাজনীতি করা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো এই যে “পারে” বললে এটাকে সুযোগ হিসাবে ধরে ধনঁংব করারও সুযোগ তৈরী হয়ে যায়।
পরিচিতি : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় / সূত্র : ফেসবুক