কামরুল হাসান মামুন, ফেসবুক থেকে: এই দেশে বেচারা শিক্ষকরা হলো সবচেয়ে সহজ বলির পাঁঠা। আর সেটা স্কুলের শিক্ষক হলেতো কথাই নেই। ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যা পরবর্তী যা কিছু ঘটছে বা হচ্ছে তাতে সকলের রাগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যাচ্ছে স্কুলের শিক্ষকরা। প্রত্যেকটি স্কুলের একটি ডিসিপ্লিন আছে। অভিভাবকরা সেই স্কুলই তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখেন যেই স্কুলের ডিসিপ্লিন যত স্ট্রিক্ট। আমাদের বাবা মায়েদের পছন্দের স্কুলের তালিকার শীর্ষে হলো ক্যাডেট কলেজ। আপনার পরিচিত কেউ যদি ওখানে পড়ে থাকে তাহলে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন কি স্টিম রোলার চালায় তারা। সত্যি বলতে কী, আমাদের অভিবাবকরা এক্সাক্টলি এটাই চায়।
স্কুলে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ। আমাদের বড় মেয়ে বিয়াংকাকে আমরা মোবাইল দিয়েছি প্রায় দেড় বছর আগে, ও যখন দশম শ্রেণীতে উঠে। অনেক সময়ই দেখা যায় ওদের স্কুল থেকে আনতে গিয়ে প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম তাই পৌঁছুতে দেরি হচ্ছে। একটি ফোন করে ওকে জানালে ও একটু স্বস্তি পায়। ও এখন একটু বড় হয়েছে তাই মাঝে মাঝে শুধু ড্রাইভারের সাথে বন্ধুর বাসায় কিংবা মোক টেস্ট দিতে কোচিং সেন্টারে পাঠাই। তখন গন্তব্যে পৌঁছেই ফোন দেওয়া, ক্লাস শেষে ফোন দেওয়া ইত্যাদি এইরকম আরো অনেক সুবিধার কথা উল্লেখ করতে পারব। তবে ওকে বলে দেয়া আছে স্কুলে পৌঁছে ক্লাস শুরুর টাইমের আগে অবশ্যই ফোন বন্ধ করে রাখতে এবং ক্লাস শেষে মোবাইল অন করতে। আজ পর্যন্ত এর অন্যথা হয়নি। ক্লাস টাইমে ফোন করে দেখেছি ওর ফোন বন্ধ।
অর্থাৎ স্কুলে যদি নিয়ম থাকে সেটা অবশ্যপালনীয় হিসাবে শিক্ষাটা বাবা-মাকে তার সন্তানকে দিতে হবে। তবে সব ছেলে মেয়ে যেমন এক না, সব বাবা-মাও এক না। তেমনি সব শিক্ষকও এক না। আর আমাদের দেশের শিক্ষকরা কি সত্যিকারের যোগ্য শিক্ষক কিনা সেই নিয়েতো আমার প্রশ্ন আছে এটা সবাই নিশ্চই জানে। এখন অরিত্রী মোবাইল নিয়েছে সেটা সে অন্যায় করেছে। সাথে সঠিক গাইড দিতে না পারার জন্য বাবা-মায়েরও দায় আছে। মোবাইল নেওয়া এবং ওটা ব্যবহার করে নকলের অভিযোগও আছে, যেটা আরো গুরুতর। নকল বা চিটিং পৃথিবীর কোথাও কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সহজভাবে নেয় না। কিন্তু আমাদের বিচার করতে হবে আমাদের দেশের পার্সপেক্টিভ থেকে। এই দেশে নকল প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদির সাথে স্বয়ং বাবা মা এমন কি স্কুলের শিক্ষকরাও জড়িত। সেই রকম পার্সপেক্টিভ থেকে দেখলে অরিত্রী আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের একটি ভিক্টিম। সরকার যদি আমাদের সমাজকে এমনভাবে তৈরী করতে পারতো যেখানে নো নকল, নো প্রশ্ন ফাঁস। সেইরকম একটি সমাজে আমাদের এই অরিত্রী হতো অন্যরকম অরিত্রী।
মোবাইল ফোন নেওয়া এবং নকলের অভিযোগে স্কুলের শিক্ষকরা হয়ত একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অরিত্রীর সামনে বাবা-মাকে অপমান করা একদম ঠিক হয়নি। সেই মাপের সংবেদনশীলতা কি আমরা আমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে আশা করতে পারি? আমরা কি সেইরকম মানের শিক্ষক নিয়োগ দেই? তাছাড়া এই প্রশ্নওতো থেকে যায় যে, বাসায় গিয়ে অরিত্রীর বাবা হয়ত তাকে বলেছে তোমার জন্য আজ আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। হয়ত এইরকম কথা ওই কচি মন বইতে পারেনি। তাই শুধু স্কুলের ওই একজন শিক্ষককে বিচারের নাম জেলে নিলেই এর বিচার হয়ে গেল না। আমাদেরকে সমস্যার ভিতরে ঢুকতে হবে। আমাদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, গভর্নিং বডির নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং স্কুল পরিচালনায় তাদের ভূমিকা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা, অভিভাবকদের ভূমিকা, মোটা দাগে সমাজের ভূমিকা ইত্যাদির একটি ওপেন হার্ট সার্জারি জরুরি। সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব
একজন ছোটখাটো শিক্ষককে এইভাবে জেলে নিয়ে শিক্ষক সমাজকে অপমানিত করলে এর একটি সামগ্রিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে যা হয়ত আমরা টেরই পাচ্ছি না। হ্যা, শিক্ষকরা যেহেতু ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশনে যায়, তাদের প্রেসার দেয় সেহেতু ছাত্রছাত্রীরা অনেকক্ষেত্রে রাগ থাকতে পারে। আমি এও দেখেছি যেই শিক্ষক সবচেয়ে বেশি করা ছিল সেই শিক্ষককে হয়ত যাপিত সময়ে পছন্দ করেনি কিন্তু বড় হয়ে যখন পেছন ফিরে তাকায় তখন তার প্রতিই বেশি কৃতজ্ঞ থাকতে। উল্টোটাও হয়। অনেকে করা হতে গিয়ে এমন করা হয় যে অনেকের জীবনকে ধ্বংসই করে দেয়। এতে বোঝা যায় জীবনে শিক্ষকের গুরুত্ব কত। দিনশেষে ছাত্রদের শিক্ষকদের উপর আস্থা রাখতে হবে কারণ জ্ঞানের প্রবাহ নিরবিচ্ছিন্ন করতে হলে সম্মানের ঢাল যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঢাল যেন কমে না যায়।