মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে: আসছে ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আশার কথা, সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সব দল তাতে অংশ নেবে। ক্ষমতাসীনদের অধীনে সেই নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই বিতর্ক ছিলো। এতে যাদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ তারা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন বা পারবেন সেটি যেমন সংশয়পূর্ণ; তেমনি তফসিল ঘোষণা, মনোনয়ন জমা, মনোনয়ন বাতিল ও পুনঃগ্রহণের ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশনের শেষাবধি নিরপেক্ষ থাকাটাও যেন প্রশ্নসাপেক্ষ। ‘ইভিএম মেশিন’ ব্যবহার ও বিদেশী পর্যবেক্ষকদের যথোপযুক্ত অনুপস্থিতিতে দেশীয় পর্যবেক্ষকরা যেখানে ‘মূর্তির’ মতো ভূমিকা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেখানে টরন্টো প্রবাসী বন্ধুপ্রতীম ফারুক হাসানের প্রত্যাশাটি কি পূরণ হবে? তার বক্তব্য- ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার কন্যার শাসনামলে ঘটেছে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা, এখন বাস্তবিকই সেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কি জনগণের বাক-স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকারটি সুসংহত করবেন?’
আজও বিস্ময়ে ভাবি, বঙ্গবন্ধুকে সত্তরের নির্বাচনে ৮ বছর বয়সে ৬টি ভোট দেবার পর, কেন আর কখনো কাউকে বাংলাদেশে ভোট দিতে যাইনি? কেনই-বা জীবনে ২০০৩ সালে প্রথম কানাডায় একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছি? কী মূল্যবোধ ও উপলব্ধি সেই দায়িত্বশীলতাকে উজ্জীবিত করেছে? এতে ফিরে যেতে হয় ১৯৭০ সালের সেই নির্বাচনে, যা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্দীপ্ত করে।
ইতিহাস বলে- ১৯৪৭ সালে দেশবিভক্তির পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর স্বাধীন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের জন্য সরাসরি জনগণের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। ১০ দিন পর, ১৭ ডিসেম্বর পাঁচটি প্রাদেশিক সংসদের নির্বাচনও হয়; যেখানে আগেই ১৯৫৪ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে, ১৯৫১ সালে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এবং ১৯৫৩ সালে সিন্ধুতে সে ধরণের ভোটগ্রহণটি হয়েছে, হয়নি কেবল বেলুচিস্তানে। সেটা ছিল ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধানসম্মত একটি সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার পরিপূরণ। সে অনুযায়ী বিচারপতি আবদুস সাত্তার, পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে উভয় পাকিস্তান খণ্ডের দুই সহকর্মী নিয়ে নির্বাচন কমিশন ৫ কোটি ৬৯ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ ভোটারের জন্য নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়। তন্মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে ছিল ৩ কোটি ১২ লাখ ১১ হাজার ২২০ ও পশ্চিম-পাকিস্তানে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৩০ হাজার ২৮০ ভোটার। এতে ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জনসমক্ষে সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচারণা অবাধ ও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের মার্চে প্রণীত একটি ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’-এর অধীনে অখ- পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মোট ২৪টি রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করে তা প্রেসিডেন্টের সত্যায়নের নিমিত্তে তুলে ধরতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, সে পর্যন্ত প্রাদেশিক সংসদের (দায়িত্বাবলি সংবিধানে নির্ধারণ ব্যতীত) কার্যক্রম স্থগিত থাকার কথা ছিলো। ওই নির্বাচনের মেরুকরণীয় ফলাফলে দেখা যায়, পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জনের পাশাপাশি পশ্চিম-পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক পিপল’স পার্টি সংখ্যাধিক্য অর্জন করে। সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনে (পূর্ব-পাকিস্তানে: ১৬২ + পশ্চিম পাকিস্তানে: ১৩৮) আওয়ামী লীগ ৬-দফা দাবি আদায়ের ভিত্তিতে ৩৯.২% অর্থাৎ ১ কোটি ২৯ লাখ ৩৭ হাজার ১৬২ ভোটে ১৬২ আসনের মাঝে ১৬০, যেখানে বিভিন্ন দলের প্রার্থী সংখ্যা ছিল ৮৭০, তথাপি উভয় পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংখ্যা ছিল ১৭০। অপরদিকে, পিপল’স পার্টি ‘রোটি, কাপড়া অওর মাকান’ বা ‘রুটি, কাপড় ও ঘরের’ দাবিতে ১৮.৬% অর্থাৎ ৬১ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৩ ভোটে পশ্চিম-পাকিস্তানের ১৩৮ আসনের মাঝে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে ৮১ আসনে জয়লাভ করে, যেখানে প্রার্থী সংখ্যা ছিল ১০৭০; যদিও পিপল’স পার্টি একমাত্র পশ্চিম-পাকিস্তানেই দিয়েছিল ১২০ প্রার্থী। এছাড়া অপরাপর আসন পায়- জামায়াতে ইসলাম : ৪ (৬%), কাউন্সিল মুসলিম লীগ : ৭ (৬%), মুসলিম লীগ (কাইয়ুম): ৯ (৪.৫%), জামায়াতে ওলেমা পাকিস্তান: ৭ (৬%), কনভেনশন মুসলিম লীগ : ২ (৬%), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ডব্লিউ) : ৬ (২.৪%), পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি : ১ (২%), স্বতন্ত্র : ১৬ (৭%) ও অন্যান্য : ০ (১.২%)। তবে শেষটায় আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ছয়দফার অন্যতম প্রতিরক্ষা ও স্বায়ত্ত্বশাসন সম্পর্কিত দাবির পাশাপাশি পৃথক ভৌগোলিক মুদ্রা প্রচলনের অনঢ়তায় জাতীয় সংসদে বসা নিয়ে ভুট্টোর ‘টাঙ্গে তোর দেঙ্গে’ বা ‘সংসদে কেউ গেলে পা ভেঙ্গে দেবো’ এবং ‘হাম ইধার, তুম ওধার’ বা ‘আমি এখানে, তুমি সেখানে’ প্রকৃতির সংবাদ শীর্ষক মন্তব্যে অনিবার্যভাবে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে নয় মাসের মহান রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে তোলে, যার পরিণতিতে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
আমি ও আমার পরিবার গর্বিত এই ভেবে যে, আমরা ওই অবিস্মরনীয় ইতিহাস সৃষ্টির নির্বাচনের অংশীদার ছিলাম। অথচ নিজে অনুতপ্ত ‘জাল ভোট প্রদানের’ আত্মদহনের যাতনাটি বয়েছি দীর্ঘকাল, তাতে কখনোই বাংলাদেশে ভোট দিতে যেতে পারিনি। ঘটনাক্রমটি ছিল এমন, ১৯৭০ সালের ওই নির্বাচনের সময় আমরা থাকতাম পুরনো ঢাকার ফরিদাবাদের শাখারী নগরে। ছাত্র ছিলাম তৎকালীন গেন্ডারিয়া হাই স্কুলে। বঙ্গবন্ধু এখানে অর্থাৎ ঢাকা-৮ আসনে লড়েছেন পূর্ব-পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান খাজা খায়রুদ্দিনের বিরুদ্ধে এবং জিতেছেন বিপুল ভোটে, যদিও ওই ফলাফলটি এখন নিরুদ্দেশ। আমার পিতা-মাতার জন্য নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রটি ছিল ফরিদাবাদ মাদ্রাসায়। ভোটের দিন বাবা সকালে নিজে ভোট দিয়ে এসে মাকে বলেছিলেন আমাকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে। দুপুরের দিকে মাকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে দেখি মহল্লার বড় ভাইয়েরা এবং কয়েকজন সহপাঠী সেখানে নৌকার প্রচারণায় ব্যস্ত।
তারা মাকে বলেন, চাচী নৌকায় ভোট দেবেন। মা হেসে সম্মতি দেন। ভোট শেষে মাকে বাসায় রেখে এক দৌড়ে সহপাঠীদের দেখতে যাই। ততক্ষণে তাদের অনেকেই একাধিকবার ভোট দিয়ে নিজেরা সীমাহীন উচ্ছ্বাস ও উৎসাহে ছুটোছুটি করছে। এক পর্যায়ে ওরা আমাকে ভোটদানে উৎসাহী করে এবং বড় ভাইদের কাছে নিয়ে যায়। বড়রা ভোটের তালিকা থেকে একটি নাম বের করে বললেন- এই নাম, ঠিকানা ও বয়স মুখস্থ করে লাইনে দাঁড়াবে এবং ভেতরে গিয়ে বলবে ও ব্যালট পেপারে নৌকার পাশে সীল মারবে। আমি দুরু দুরু বুকে তাই করলাম এবং নির্বিঘ্নে সফলকাম হলাম। এসেই বড়দের বলতেই তারা আমার আঙ্গুলের অমোচনীয় কালি লেবুর খোসার রসে কাপড়ে মুছে আবারো প্রস্তুত করলেন। এভাবে বিকেল নাগাদ ছয়টি ভোট প্রদান শেষে কোথায় ছিলাম সেই ইতিবৃত্তটি মাকে এসে বলি। মা শুনে হতভম্ব। বললেন, তোমার বাবা শুনলে ভীষণ পিটাবে। এরপর তিনি একটি গল্প বলেন। গল্পটি ছিলো এমন, এক কারাবন্দি দয়ালু অথচ খুনি ডাকাতের বিচারের রায় কোর্টে ঘোষনা করা হবে। তবু কৌতুহলী বিচারক রায় ঘোষণার আগে ডাকাতকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার জীবনের প্রথম অপরাধের ঘটনাটি কি মনে পড়ে? উত্তরে কিছুক্ষণ ভেবে সে বলে, একদিন সে প্রতিবেশীর মুরগীর ডিম চুরি করে তার বাসায় নিয়ে যায়।
সেটা দেখে তার মা উদ্বেলিত হয়ে বলেন, ‘সাবাস ছেলে, এভাবে আরও ডিম আনবে।’ কিন্তু আমার ভোটদানের ঘটনায় মা আমাকে গালে একটি চড় দিয়ে অনেক বকাঝকা করেন। এতে আজ অবধি পুরো ঘটনাটি দুঃসহ অনুতাপের হয়েছে। অনেক বন্ধুকেই বলেছি। কারণ, অনার্সে পড়াকালীন সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট দর্শনের নীতিশাস্ত্রে পড়েছি- উদ্দেশ্য, প্রেষণা ও কার্যকারণ। অর্থাৎ উদ্দেশ্যটাই মুখ্য, ফলাফল যতই মহৎ হোক না কেন এবং অমূল্য বাণী ‘অতৃপ্ত আত্মা পাঁজি আত্মা’। আজ এতো বছর পর দুই সন্তানের জনক হিসেবে জাতির সামনে নিজের শিশু বয়সের অপরাধটি স্বীকার করে আপামর ভোটারদের নৈতিক দায়িত্বটি পালনে উৎসাহিত করছি, যাতে তাদের অমূল্য ভোটটি জালিয়াতি না হয়। কেননা বর্তমান ন্যাশনাল আইডি ও ছবি সম্বলিত ভোটার তালিকার যুগে এবং ‘ভোট পাহাড়া’ ও ‘ভোট রক্ষা’র মতো পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন বলছে ‘কারো ভোট জালিয়াতি হলে তা আবারও চ্যালেঞ্জে প্রদান করা যাবে’!
ই-মেইল: bukhari.toronto@gmail.com
সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব